হেনা ভাইয়ের সাথে পরিচয় এবং কিছু কথা

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

ব্লগে লেখালেখি করতে গিয়েই হেনা ভাইয়ের সাথে পরিচয়। আমি তখন ছড়া লিখতাম। আমার ছড়া পড়ে উনি উৎসাহমূলক মন্তব্য করতেন, তাতে আমার ছড়া লেখার উৎসাহ বৃদ্ধি পেত। আমিও তার লেখা গল্পগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তাম এবং ভালো-মন্দ নানা ধরনের মন্তব্য প্রতিমন্তব্য করতে পিছপা হতাম না। মন্তব্য প্রতিমন্তব্যর মাধ্যমেই আমাদের ভার্চুয়াল জগতে পরিচয়।

এক পর্যায়ে ফোন নাম্বার লেনদেন হলো। ফোন নাম্বার পেয়ে আমাদের দুইজনের বন্ধুত্ব আরো বেড়ে গেল। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কথা হতো। মাঝে মাঝে এমন হতো কথা বলতে বলতে আমাদের ফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে যেত আমরা টেরই পেতাম না। তবে আমাদের বেশিরভাগ কথা হতো সাহিত্য নিয়ে। ব্যাক্তিগত কথা খুব কম হতো। এভাবেই কথা বলতে বলতে একদিন উপযাচক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, হেনা ভাই, আপনি তো অনেক গল্প লিখেছেন, আপনি কি কোন বই বের করেছেন? উনি হাসি দিয়ে বললেন, “স্বপ্ন বাসর” নামে একটি আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশ করেছি, তবে এই বইটি কোন প্রকাশনার মাধ্যমে বের করি নাই নিজে নিজে বের করেছি। আমি বললাম, বইটি কোথায় পাবো? হেনা ভাই বলল, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে কিছু বই দেয়া আছে, সেখানে পেতে পারেন। আমি বললাম, ঠিক আছে– আমি সেখান থেকেই বইটি সংগ্রহ করে নিব। আমার বই সংগ্রহের আগ্রহ দেখে উনি তাড়াতাড়ি বললেন, না না আপনাকে কিনতে হবে না, আমিই এক কপি পাঠিয়ে দিব।

এই কথোপোকথনের ঠিক তিন চার দিন পরে ২০১৩ সালের এপ্রিলের ১৭ তারিখে অফিসে বসে আছি, এমন সময় পোষ্ট অফিসের পিয়ন এসে মোটা খামে মোড়ানো একটি বই হাতে ধরিয়ে দিল। ডাকে পাঠানো পার্সেল খামের উপরে চোখ পড়তেই হেনা ভাইয়ের ঠিকানা দেখতে পেলাম। হেনা ভাইয়ের নাম দেখে বুঝতে আর দেরি হলো না এটা হেনা ভাইয়ের পাঠানো বই। বইয়ের প্যাকেট হাতে পেয়ে আর তর সইলো না। মোড়ক খুলেই কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে ফেললাম। বই পড়া শুরু করে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এত সুন্দর রসালো এবং হৃদয়গ্রাহী লেখা, যত পড়ি ততই পড়তে ইচ্ছা করে, পড়া বন্ধ করতেই ইচ্ছা করছে না। কিন্তু অফিসের কাজ থাকায় ইচ্ছা থাকলেও পড়া সম্ভব হলো না। অনিচ্ছা সত্বেও বই বন্ধ করে অফিসের কাজ করতে লাগলাম।

অফিসের কাজ শেষ করে যখন বাসায় ফিরলাম তখন রাত নয়টা। কাপড় চোপর খুলে ফ্রেস হওয়ার আর তর সইলো না। প্যান্ট পরা অবস্থায় বিছানার বালিসে হেলান দিয়েই পড়তে লাগলাম। পড়তে পড়তে কখন যে রাত দেড়টা বেজে গেছে বুঝতেই পারি নাই। মন্ত্র মুগ্ধের মত একটানা পড়েছি। যখন পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছি তখন ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। খাওয়ার টেবিলে গিয়ে দেখি ভাত ঠান্ডা হতে হতে পানি পানি হয়েছে। পানি ছেড়ে দেয়া ম্যারম্যারে ভাত নাকে মুখে খেলাম ঠিকই কিন্তু খেয়ে কোন মজা পেলাম না। মনে মনে ভাবলাম ভাত খেয়ে মজা না পেলেও বই পড়ে তো মজা পেয়েছি এর চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কি হতে পারে। সচারাচর এমন ধরনের পাঠক ধরে রাখার মত বই খুব একটা পাওয়া যায় না, পাওয়া গেলে যে কোন পাঠকেরই নাওয়া খাওয়ার কথা ভুলে যাওয়া নতুন কিছু নয়।

খাওয়া শেষ করে কম্পিউটার ওপেন করে বসলেও ব্লগে মন বসাতে পারছিলাম না। নিজের আত্মজীবনী দিয়ে এত সুন্দর উপন্যাস লেখা যায় এটা আমার ধারনাই ছিল না। মাথার মধ্যে পুরো কাহিনীটা বার বার ঘুরতে লাগল। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম যদি হেনা ভাইয়ের উপন্যাসের কাহিনি দিয়ে একটা ছড়া লিখতে পারতাম, তাহলে কেমন হতো। বিষয়টি চিন্তা করতে না করতেই ছড়ার প্রথম লাইন মাথায় চলে এলো, “আলেয়া তুমি আলেয়া হয়ে — -” দেরি না করে কম্পিউটারে লেখা শুরু করে দিলাম। লিখতে লিখতে যখন ছড়া লেখা শেষ পর্যায়ে এসেছি তখন ভোরের আজান দিয়ে দিয়েছে। সারা রাত ঘুম আর হলো না। সকাল বেলা নাস্তা করেই শুয়ে পড়তে হলো।

বেলা ১২টার দিকে হেনা ভাইকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য ফোন করলাম। উনি ফোন ধরেই সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, প্রামানিক ভাই বই পেয়েছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ ভাই, বই পেয়েছি এবং পুরো বই পড়ে সেই কাহিনী দিয়ে রাতে ছড়াও লিখেছি, এখন আপনার অনুমতির অপেক্ষায় আছি, আপনি অনুমতি দিলে ছড়াটি ব্লগে পোষ্ট করতে পারি।
হেনা ভাই খু্ব খুশি হয়েই বললেন, বলেন কি! আপনি এত তাড়াতাড়ি আমার উপন্যাসের কাহিনী দিয়ে ছড়া লিখেছেন। এ যে আমার কানকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি দেরি না করে এখনই পোষ্ট দেন আমি দেখবো।
আমি বললাম, ঠিক আছে ভাই, আমি সব রেডি করে রেখেছি, এখনই পোষ্ট করে দিচ্ছি।
আমি সাথে সাথেই ছড়ার প্রথম পর্ব পোষ্ট করে দিলাম। পোষ্ট পেয়ে কিছুক্ষণ পরেই হেনা ভাই আমায় ফোন করে সালাম দিয়েই ধন্যবাদ জানালো। তার সালামের জবাব দিয়ে কিছু কথা বলার পর আমি বললাম, হেনা ভাই, আমি আপনাকে একটা পার্সোনাল কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, আপনি যে কি মনে করবেন এটাই চিন্তা করছি।
হেনা ভাই অভয় দিয়ে বললেন, বলেন বলেন কোন অসুবিধা নাই।
আমি বললাম, আপনার এই প্রেমের কাহিনি কি ভাবী জানেন?
হেনা ভাই এক গাল হাসি দিয়ে বললেন, জী ভাই, আমার স্ত্রী জানে। আমি তাকে বিয়ের পরেই সব জানিয়েছি।
আমি বললাম, ভাবী জানার পরে কি বলল?
হেনা ভাই বললেন, আমার স্ত্রী এটাকে সহজ ভাবেই মেনে নিয়েছে। কারণ তাকে আমি পুরো ঘটনা খুলে বলেছি। পুরো ঘটনা শুনে আমাকে এটাই বলেছে, এতে তো তোমার দোষ দেখি না, যা হয়েছে তোমার পরিবারের ইচ্ছাতেই হয়েছে। যেহেতু তোমার নিজের ইচ্ছায় এমন ঘটনা ঘটে নাই কাজেই এতে আমি তোমার প্রতি অখুশি নই।
বাঙালি মহিলারা সাধারণত স্বামীর এই ধরনের দোষত্রুটি সহজে মেনে নিতে চায় না। এসব নিয়ে স্বামী স্ত্রী কুরুক্ষেত্র বেধে থাকে। আমিও ভেবেছিলাম হেনা ভাইয়ের ক্ষেত্রেও হয়তো এমন কিছু একটা ঘটেছে কিন্তু হেনা ভাইয়ের কাছে ভাবীর সহজ সরল ভাবে ঘটনাটি মেনে নেয়ার কথা শুনে ভাবীর প্রতি শ্রদ্ধা বহুগুনে বেড়ে গেল। ভাবীকে অনেক বড় মনের পরিচায়ক মনে হলো। আমি দূর থেকেই তাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে হেনা ভাইকে বললাম, আপনি প্রথম প্রেমের প্রেমিক হারিয়ে যত না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এই ভাবীকে পেয়ে হয়তো তার চেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন।
আমার কথা শুনে হেনা ভাই হাসতে হাসতে বললেন, জী ভাই, আমরা স্বামী স্ত্রী খুব সুখেই আছি, আমাদের মধ্যে কোন ঝগড়া ঝাটি নাই, এই দিক দিয়ে আল্লাহ আমাদের সুখেই রেখেছে।
হেনা ভাইয়ের সুখের দাম্পত্য জীবনের কথা শুনে খুব ভালো লাগল। হেনা ভাইকে বললাম, ভাবীকে আমার ছালাম জানাবেন।
হেনা ভাই আবারো হাসতে হাসতে বললেন, আপনার ভাবী আমার পাশেই আছে, আমি এখনই আপনার ছালাম পৌছে দিচ্ছি, বলেই ভাবীকে ডেকে বললেন, এই এদিকে আসো– আমাদের ব্লগার প্রামানিক ভাই তোমাকে ছালাম দিয়েছে ছালাম গ্রহণ করো। একথা বলেই হেনা ভাইসহ দুইজন হাসতে লাগলেন। তাদের হাসির শব্দ পুরোপুরি না হলেও মৃদু ফোনের স্পীকারে শোনা যাচ্ছিল।

হেনা ভাই আমার চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের বড় হলেও বন্ধুর মত সম্পর্ক ছিল। সাহিত্যের উপর তার যথেষ্ঠ জ্ঞান ছিল। যে কোন বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি অবলীলায় বলে দিতেন। তার এই সহযোগীতা আমার লেখালেখির জন্য অনেক সহায়ক ছিল। আমার খুব ইচ্ছা ছিল হেনা ভাইয়ের সাথে দেখা করবো। হেনা ভাইকে ঢাকায় দেখা করার জন্য কয়েকবার দাওয়াতো দিয়েছিলাম। কিন্তু হেনা ভাই ঢাকায় আসলেও সময়ের অভাবে দেখা করতে পারেন নাই।

২০১৯ সালের শেষের দিকে হঠাৎ করেই হেনা ভাইয়ের সাথে ফোনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। আমি কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না। ফোন প্রায়ই বন্ধ থাকে মাঝে মাঝে খোলা থাকলেও কেউ রিসিভ করে না। ফেব্রুয়ারী মাসে হঠাৎ করেই ফোনে ভাবীকে পেয়ে গেলাম। তার কাছ থেকেই হেনা ভাইয়ের অসুস্থ্য হওয়ার খবর শুনে ব্লগে পোষ্ট দিয়েছিলাম। পোষ্ট দেখে ব্লগার কামাল ভাই বলল, প্রামানিক ভাই চলেন– হেনা ভাইকে দেখে আসি। হেনা ভাইকে দেখার আমারো খুব ইচ্ছা ছিল। আমার ইচ্ছা আর কামাল ভাইয়ের ইচ্ছা দুই ইচ্ছার মাঝখানে আমার ছোট ছেলেও ইচ্ছা প্রকাশ করে বসল, আমিও রাজশাহী দেখতে যাবো। বাধ্য হয়ে তাকেও সাথে নিয়ে গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে হেনা ভাইকে দেখতে গেলাম। আমাদেরকে তার বাসায় পেয়ে হেনা ভাই যে কি পরিমান খুশি হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ব্রেন স্ট্রোক করে শরীরের একপাশ অচল হয়ে গেছে, ঠিক মত হাটতেও পারে না কথাও বলতে পারে না। কথা বলতে না পারার যে কি কষ্ট সেটা সচোখে দেখতে হলো আমাদেরকে। বাসার দরজায় গিয়ে আমাদের নাম বলতেই হাটতে পারেন না তারপরেও পা টেনে টেনে মেইন দরজায় এসে আমাকে আর কামাল ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন। মানুষ ছোট কালের বন্ধুদেরও এভাবে জড়িয়ে ধরে না।

দুপুরে গিয়েছি। যাওয়া মাত্রই খাবার খেতে দিলেন। আতিথেয়তায় ভাবীর প্রশংসা করতে হয়। ভাবী খুবই আন্তরিক এবং অতিথি পরায়ন। মাছ, মাংস, শাক, সব্জীসহ অনেক কিছু রান্না করেছেন। জীবনের প্রথম গিয়ে এত খাবার পাবো কল্পনা করি নাই। খাওয়ার টেবিলে আমাদের পাশেই হেনা ভাইও বসলেন। তিনি কিছু খেলেন না। পরে লক্ষ্য করলাম খাওয়ার জন্য তিনি বসেন নাই, আমাদেরকে খাওয়ানোর জন্য বসেছেন। কথা বলতে না পারলেও হাতের ইশারায় ভাবীকে তরকারীর বাটি দেখিয়ে দিচ্ছেন, এইটা দাও ওইটা দাও বেশি বেশি দাও। অসুস্থ্য মানুষ হয়েও তিনি যে আতিথেয়তা দেখালেন তা অবর্ননীয়।

হেনা ভাইয়ের ভিতরে জমানো অনেক কথা তিনি বলার খুব চেষ্টা করলেন কিন্তু বলতে পারলেন না। মুখে কোন শব্দ উচ্চারন হয় না। কথা বলতে না পারার কষ্টে দুই চোখের পানি ছেড়ে কাঁদতে লাগলেন। তার কান্না দেখে আমাদেরও কান্না পাচ্ছিল। মুখে কিছু বলার চেষ্টা করেও যখন বলতে পারছে না তখন অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে হাতের ইশারায় বুঝানোর চেষ্টা করলেন। তার হাতের ইশারা কিছু বুঝলেও বেশিরভাগ বোঝা সম্ভব হলো না। তার এরকম অবস্থা দেখে খুব কষ্টই লাগল।

বিদায় নেয়ার সময় হাঁটতে পারেন না তারপরেও পা টেনে টেনে বাইরের গেট পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। তার অচল অবস্থা দেখে না আসার জন্য অনেক নিষেধ করলাম কিন্তু তিনি মানলেন না। বাহিরের গেট পার হয়ে রাস্তায় এসে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি হেনা ভাই দু’হাতে গেট ধরে আমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে ভেজা ভেজা চোখে তাকিয়ে আছেন। আমরা বাসার ভিতরে যেতে বললেও গেলেন না। আমরা আড়াল না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাদের প্রতি এভাবেই তাকিয়ে রইলেন। হেনা ভাইয়ের বাসায় তিন ঘন্টার মত ছিলাম। তিন ঘন্টার যে স্মৃতি বুকে ধারন করে আছি তা ভুলে যাবার মত নয়। ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুরাও যে পরস্পরের প্রতি এত আবেগ প্রবণ এবং আন্তরিক হয় তা স্বচোক্ষে না দেখলে বলে বুঝানো যাবে না।

ব্লগে হেনা ভাইয়ের সাথে পরিচয় প্রায় এক দশক আগে। এক দশক পরে তার সাথে দেখা করতে যাওয়াটাই যে জীবনের প্রথম এবং শেষ দেখা হবে তা কল্পনাও করতে পারি নাই। আমাদের দেখে আসার ঠিক একমাস পরেই হেনা ভাই এপ্রিলের দুই তারিখে মৃত্যুবরণ করেন।

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *