রেল লাইনের পাশের বাড়ি

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

কলেজ থেকে ফিরতে দুপুরের ট্রেন অল্পের জন্য ফেল হয়ে গেল। পরবর্তী ট্রেনে যখন ফিরছি তখন অনেক রাত। ট্রেন থেকে নেমে দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ে গেলাম। স্টেশন থেকে আরো প্রায় চার মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে যেতে হবে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আমার গ্রামে যাওয়ার মত কোন সাথী খুঁজে পেলাম না। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের শরীর নিজে দেখা যায় না। পথে যেতে রাস্তার পাশেই একটি পোড়ো ভিটা আছে। ভূতের ভয়ে দিনেই গা ছম ছম করে, রাতে এই ভিটার পাশ দিয়ে একা একা যাওয়া আরো ভয়ের ব্যপার। তাছাড়া ঘরবাড়িবিহীন দু’টি ফাঁকা মাঠও পেরিয়ে যেতে হবে। অন্ধকারে বিপদ সঙ্কুল এত পথ একা একা যেতে সাহস হচ্ছে না। এখানে থেকে যাবো সে ধরনের কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়িও নেই। এই অবস্থায় আমি যখন বাড়ি যাওয়ার অনিশ্চয়তা নিয়ে এদিক ওদিক অসহায়ের মত তাকাচ্ছি তখন আমার অবস্থা আঁচ করতে পেরে বাবু এগিয়ে এলো। আমার হাত টেনে ধরে বলল, চল আমার বাড়ি চল, এত রাতে একা একা বাড়ি যেতে পারবি না।

বাবু আমার ক্লাসমেট। কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছু দিন পর থেকে বাবুর সাথে পরিচয়। এক ক্লাসেই পড়ি। সেও ট্রেনে যাতায়াত করে। চলার পথে হালকা পাতলা কথা হলেও তেমন ঘনিষ্ট তখনও হইনি। অল্প পরিচয় হওয়ায় ওর সাথে যেতে ইতস্তত করতেছিলাম। কিন্তু বাবু যাওয়ার জন্য বেশ ভালই জোরাজুরি করতে লাগল। মনে মনে ভাবলাম, বাবুর এই আদর উপেক্ষা করলে রাতের ভোগান্তি কপালে ভর করবে। সারা রাত আলো বিহীন স্টেশনে মশার কামড় খেয়ে একা একা বসে থাকতে হবে। ভোগান্তির চেয়ে লজ্জা শরম ফেলে বাবুর সাথে যাওয়াই ভালো হবে। অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে বাবুর বাড়ি যেতে রাজী হলাম।

আমি রাজী হওয়ায় বাবু আমাকে সাথে নিয়ে স্টেশন থেকে রেল লাইন ধরে সোজা দক্ষিণ দিকে রওনা হলো। বাবুর বাড়ি সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নেই। এর আগে কখনও বাবুর বাড়ি যাইনি। কিন্তু আজ বিপদে পড়ে যেতে হচ্ছে। বিড়াল ঠেলায় পড়ে যেমন গাছে উঠে আমারও সেই অবস্থা।

কিছুদূর যেতে না যেতেই ছোট একটি রেলের ব্রিজ। ব্রিজ পার হতে হবে। আমি রেলের ব্রিজ দিনের বেলাতেই পার হতে ভয় পাই। কারণ ব্রিজে একফুট পর পর কাঠের স্লিপার দেয়া থাকে। দুই স্লিপারের মাঝখানে ফাঁকা। এই ফাঁক দিয়ে একবার পা পিছলে পড়ে গেলে আর রক্ষা নাই– সোজা বিশ ফুট নিচে অথৈ পানিতে তলিয়ে যেতে হবে। ব্রিজের নিচে গভীর কালো পানির তলে দেও দৈত্য কি আছে না আছে আল্লাই ভালো জানে। স্লিপারের ফাঁক দিয়ে নিচের দিকে তাকালে দিনের বেলাতেই মাথা ঘোড়ে, তারোপর অন্ধকার রাত। কিছু দিন আগে এই ব্রিজের তলায় নাকি মরা মানুষ পাওয়া গিয়েছিল। এসব কথা মনে হতেই ভয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। আমার পক্ষে আর ব্রিজ পার হওয়া সম্ভব হলো না। ব্রিজে উঠে দু’তিনটি স্লিপার টপকাতেই শরীর কাঁপতে লাগল। ভয়ে আবার পিছনে ফিরে এলাম। বাবু হন্ হন্ করে ব্রিজের মাঝামাঝি চলে গেছে, ব্রিজের মাঝখানে গিয়ে পিছন ফিরে আমাকে না দেখতে পেয়ে ডাক দিল, কিরে– কই তুই?
অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমি বাবুর কথায় সায় দিয়ে বললাম, আমি এপারে দাঁড়িয়ে আছি।
— দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ব্রিজ পার হয়ে চলে আয়।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, নারে — আমি ব্রিজ পার হতে পারবো না।
— কেন কি হয়েছে?
— ব্রিজে উঠতে আমার ভয় করে।
বাবু ধমক দিয়ে বলল, দূর হারামজাদা, এই বয়সে যদি ব্রিজ পার হতে না পারিস তো কোন বয়সে পার হবি রে?
বাবু বন্ধুসুলভ ধমকের সাথে কথাগুলো বলেই ব্রিজের মাঝখান থেকে আবার পিছনে ফিরে এলো। আমার কাছাকাছি এসে বলল, আমার হাত ধর।
আমি বাবুকে নিষেধ করে বললাম, নারে ভাই, আমি এই ব্রিজ পার হতে পারবো না, তার চেয়ে আমি স্টেশনে ফিরে যাই, তুই বাড়ি চলে যা।
বাবু কিছুটা ধমক দিয়েই বলল, তোকে বাড়ির কাছাকাছি এনে আবার স্টেশনে পাঠাবো– এটা তুই কি করে ভাবলি? ধর ধর, আমার হাত ধর।

আমি পার হতে পারবো না নিষেধ করার পরও বাবু আমার হাত ধরে টানতে লাগল। ব্রিজ পার হওযার জন্য অনেক সাহস দিতে লাগল কিন্তু ও সাহস দিলেও আমি গরসাহসের চূড়ায় উঠে বসে আছি, কোনভাবেই ব্রিজে উঠতে রাজী হলাম না, অবশেষে আমার অবস্থা বুঝতে পেরে আর বেশি জোর করল না। নিজেই ব্রিজ থেকে নেমে এসে বলল, ত্রিশ ফুটের ব্রিজের জন্য তোকে এখন তিন মাইল হাঁটতে হবে।
আমি কিছুটা অসহায়ের মতই বললাম, তিন মাইল হাঁটতে রাজী আছি তবু আমি এই ত্রিশ ফুটের ব্রিজ পার হতে পারবো না।
আমার কথা শুনে বাবু কিছুটা বিদ্রুপাত্মক সুরে বলল, তোর মত এত ভীতু মানুষ তো কখনও দেখি নাই রে। ছোট একটা ব্রিজ পার হতে পারিস না, ভয়ে হাঁটু কাঁপাকাপি শুরু করেছিস, বড় ব্রিজ পার হবি কেমনে? ঠিক আছে আয়, আমার সাথে সাথে আয়। বলেই উল্টো স্টেশনের দিকে রওনা হলো।

আমাকে সাথে নিয়ে আবার স্টেশনের দিকে রওনা হওয়ায় মনে মনে ভাবলাম, বাবুর সাথে এসে বাবুকে খামাখা বিপদে ফেললাম, এতক্ষণ বাড়ি গিয়ে বেচারা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। আমার জন্য এখন সে রাত জেগে তিন মাইল রাস্তা হাঁটবে। বাবুর কষ্টের কথা ভেবে নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। খারাপ লাগলে কি হবে, বাবুকে এখন নিষেধও করতে পারতেছি না। এত রাস্তা হেঁটে এসে যদি বলি আমি আর যাবনা, তাহলে সে আমাকে স্বার্থপর ভাববে।

স্টেশনের কাছাকাছি গিয়ে বাবু রেল লাইনের পূর্বপাশের খাড়া ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেল। আমাকেও তার পিছনে পিছনে নামতে বলল। নিচে নেমে পায়ে হাঁটার কাঁচা রাস্তা পেলাম। রাস্তা ধরে প্রায় আধা ঘন্টা হাঁটার পর আবার রেল লাইনে উঠলাম। রেল লাইন ধরে আরো কিছুদূর যাওয়ার পর বাবুর বাড়ি পেলাম।

বাবুর বাড়ি যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে রাত এগারোটা বাজে। রেল লাইনের পাশেই বাড়ি। বাবুর থাকার ঘরটি লাইন থেকে মাত্র ৫০ হাত দূরে। গ্রাম এলাকায় রাত এগারোটা মানে গভীর রাত। সবাই ঘুমিয়েছে। কোন কোন ঘর থেকে নাক ডাকার শব্দও কানে আসছে। বাবু বাড়ির ভিতরে গিয়ে দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের দরজায় ‘মা’ বলে ডাক দিতেই বাবুর মা ‘উঁ’ বলে জবাব দিলেন। মনে হলো সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেও শুধু বাবুর মা একাই জেগে আছেন। মায়েরা এমনই হয়। আমারো মা আমার জন্য রাত জেগে বসে থাকতো। যত রাতেই ফিরি না কেন, মায়ের ঘরের সামনে গিয়ে ‘মা’ বলে ডাক দিতেই মা জেগে উঠত। আজ মা নেই এক ডাকে আর কেউ ঘুম থেকে উঠে না। গভীর রাতে অত সহজে কেউ ভাতও বেড়ে দেয় না। মায়ের সেই স্মৃতিগুলো এখন শুধু চোখে চোখে ভাসে।

প্রথম ডাকেই মায়ের সারা পেয়ে বাবু তার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। আমি বাইরে দাঁড়ানো ছিলাম। বাবুর মা ঘরের বাইরে এসে আমাকে দাঁড়ানো দেখে বাবুর নাম ধরে ডেকে বলল, বাবু–তোর সাথে কেউ এসেছে রে?
বাবু জবাব দিল, আমার বন্ধু এসেছে মা।
— তোর বন্ধুকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন? হাত মুখ ধুতে পানি দে।
বাবু ঘর থেকে কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বালিয়ে নিয়ে এলো। ল্যাম্পের আলোতে দুই জনেই কলপাড়ে গেলাম। টিউবওয়েলের পানিতে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই বাবুর মা ভাত নিয়ে এলেন।

আমি আর বাবু একসাথেই খেতে বসলাম। শিং মাছ দিয়ে বেগুন রান্না করেছে, সাথে মশুরের ডাল। গামলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ভাত। (অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন গভীর রাতে হঠাৎ করে উপস্থিত হওয়ার পরও এত ভাত কি করে দিল? গ্রামের গৃহস্থ বাড়িগুলোতে সবসময় দু’একজনের ভাত বেশি রান্না করা হয়। যে কারণে গভীর রাতে কেউ কারো বাড়ি গেলেও নতুন করে ভাত রান্না করতে হয় না। গৃহস্থ বাড়ির ভাত বেশি হলেও অসুবিধা নেই, কেউ ফেলে দেয় না, অতিরিক্ত ভাত সকাল বেলা পান্তা করে খায়।)

খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। সেই সকালে খেয়েছি, দুপুরে তেমন খাওয়া হয়নি। পেট ভরেই খেলাম। গভীর রাত হওয়ায় ভাত খেয়েই শুয়ে পড়েছি। সারা দিনের পরিশ্রম এবং ক্লান্তির কারণে শোয়ার একটু পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি বলতে পারবো না। হঠাৎ কিসের শব্দে কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই লোহা লক্করের ঝমর ঝমর বিকট আওয়াজে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠলাম। আমার জীবনেও এরকম শব্দ শুনি নাই। শব্দের পাশাপাশি খাটের ঝাঁকুনি শুরু হয়ে গেছে। ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো এলাকায় বড় ধরনের ভুমিকম্প বা কোন ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছে। ভয়ে শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেল। অন্তর আত্মা শুকিয়ে কাঠ। অন্ধকারে বেদিশা হয়ে গেলাম। মাগো বাবাগো বলে চিৎকার দিব দিব এমন সময় কানের কাছে বিকট শব্দে হুইসেল বেজে উঠল। কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার অবস্থা। মনে হলো হুইসেল যেন আমার কানের উপরে এসে বেজে উঠেছে। তবে হুইসেলে কানের পর্দা ফাটলেও মনের ভিতর কিছুটা সাহস জুটে এলো। বুঝতে পেলাম এটা আর কিছু নয় ঘরের পাশ দিয়ে লোহালক্করের ঝমর ঝমর শব্দ করতে করতে মাল ট্রেন যাচ্ছে। ট্রেনের বিষয়টি মাথায় আসতেই স্বস্তি পেলাম। তারপরেও অন্ধকারে কাঁপতে লাগলাম। বালিশের তলা থেকে ম্যাচ বের করে আলো জ্বালালাম। বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি বাবু অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এত বড় একটা ট্রেন কান ফাটা আওয়াজে দুনিয়া কাঁপিয়ে চলে গেল তারপরেও ওর ঘুমের কোন ব্যাঘাতই ঘটলো না। ওর ঘুমানো দেখে আশ্চার্যই হয়ে গেলাম।

কাঁচা ঘুম ভেঙে গেছে। আমার চোখে আর ঘুম আসছে না। অনেক গড়াগড়ির পর আবার একটু ঘুমিয়েছি। আবার একই অবস্থা। ঝম ঝম ঠন ঠন খটাখট্ শব্দ করতে করতে ট্রেন যাচ্ছে। শুধু ট্রেনের ঝম ঝম খটাখট্ শব্দ হলে অসুবিধা ছিল না, অসুবিধা হলো শব্দের সমতালে ভুমিকম্পের মত খাটের ঝাকুনি। শব্দ আর ঝাকুনির চোটে ঘুম এমনিতেই ভেঙে যায়। হাজার হাজার মণ ওজনের ট্রেন যখন দ্রুত গতিতে যায়, তখন শুধু রেল লাইন নয়, লোহালক্করের ভারী ওজন আর দ্রুত গতির ঠেলায় রেল লাইনের আশেপাশের মাটিও কাঁপতে থাকে। বাবুর ঘরটি রেল লাইনের কাছে হওয়ায় ঝাকুনিটা যেন আরও একটু বেশিই মনে হলো। ঝাকুনি শুরু হলে শুধু খাট নয় খাটের সাথে টিনের ঘরের চালসহ মরমর শব্দ করতে থাকে। ঘুমের ঘোরে এমন আচমকা বিকট শব্দ শুনলে যে কোন লোকই চমকে উঠার কথা, আমিও এর থেকে ব্যাতিক্রম ছিলাম না।

অনাভ্যাসের কারণে এমন পরিবেশে ঘুম আর হলো না। যতবার ঘুমিয়েছি ততবারই ট্রেন এসে ঘুম নষ্ট করে দিয়েছে। আমি ঘুমানোর পর থেকে কম পক্ষে পাঁচটি ট্রেন যাতায়াত করেছে। আমার ঘুম না হলে কি হবে বাবু ঠিকই মরার মত ঘুমিয়ে সারা রাত কাটিয়ে দিল।

ভোরের আযান হওয়ার সাথে সাথেই বাবু ঘুম থেকে উঠে গেল। আমি ঘুমিয়েছি মনে করে আমাকে ডাকল না। আমি বালিশে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। ঘুমে চোখ জ্বালা করলেও ঘুম আসছে না। অনেক গড়াগড়ি মোড়ামুড়ি করে অবশেষে ভোরের দিকে আবার একটু ঘুমিয়েছি– অমনি ট্রেন এলো। আবার ট্রেন চলার ঝন ঝন ঠন ঠন খটাখট্ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। বিরুক্ত হয়ে রাগে দুঃখে ভোর থাকতেই বাড়ির দিকে রওনা হলাম। বাবু বাড়ির সামনে রেল লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবুর কাছে বিদায় চাইতেই ও নিষেধ করতে লাগল। ওর নিষেধ সত্বেও বাড়ির দিকে রওনা হলাম। আমাকে যেতে দেখে দৌড়ে এসে পাঁজা করে ধরল।
আশ্চার্য হয়ে বলল, তুই কি পাগোল নাকি রে! জীবনের প্রথম আমার বাড়িতে এসে না খেয়ে যাবি, আমি কি তাই তোকে যেতে দিব? তুই কি করে ভাবলি– সকালের নাস্তা না খাইয়েই তোকে বিদায় দেব?

বাবুর আন্তরিকতার অভাব নাই। আমি জানি গ্রামের বন্ধুরা এমনই হয়। কিন্তু সারা রাত ঘুম না হওয়ায় চোখ জ্বলতেছিল, মাথা ঘোরার কারণে কিছুই ভালো লাগছিল না, অস্বস্তিবোধ করতেছিলাম। শুধু ঘুমের কারণে চলে যাচ্ছি এ কথা বাবুকে বলতেও পাচ্ছিলাম না।

বাবু আমাকে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরে আছে । কোনভাবেই ছাড়ছে না। নাস্তা না খেয়ে যেতেই দিবে না। সহজ কথায় ছাড়ছে না দেখে বাবা মায়ের দোহাই দেয়া শুরু করলাম। অনেক অনুনয় বিনয় করে বললাম, সকালের নাস্তা করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে রে। আমি তাড়াতাড়ি না গেলে মা বাবা খুব চিন্তা করবে। আমার মনে হয় এমনিতেই মা আমার জন্য সারারাত ঘুমায়নি, তারোপর যদি যেতে দেরি করি তাহলে হয়তো মা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে লোক দিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে।

মায়ের কথা বলার পর বাবুর কঠোর মনোভাব কিছুটা নরম হলেও আরো কিছুক্ষণ আমার হাত ধরে রইল। আমি তার এত অনুরোধ সত্বেও দেরি করতে রাজি না হওয়ায় বাবু মুখটা ভার ভার করে হাত দু’টা ছেড়ে দিল।

নাস্তা না খেয়ে রওনা হওয়ায় বাবু খুব মনঃক্ষুন্ন হয়েছে। আমার সাথে সাথে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে এলো। তার মনঃক্ষুন্ন ভাব দেখে একবার মনে হলো– ফিরে গিয়ে বাবুর সাথে নাস্তা করে আসি। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম এত জোরাজুরি সত্বেও যখন জোর করে বিদায় নিয়ে এতদূর এগিয়ে এসেছি তখন আবার ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না? তার চেয়ে চলে এসেছি যখন পিছন না ফিরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই ভালো।

বাবুর এই আতিথেয়তার কথা আজো ভুলতে পারিনি, বাকি জীবনেও ভুলতে পারবো না। সেই দিনের পর থেকে বাবু খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিল। এর পরে ওই বাড়িতে অনেক গিয়েছি, অনেক খেয়েছি, অনেক রাত কাটিয়েছি। কিন্তু ট্রেনের যন্ত্রনায় কখনই ঘুমাতে পারিনি।

বাবুর বাড়ির প্রথম দিনের সেই স্মৃতি মনে পড়লে আজো হাসি পায়, ভুমিকম্প মনে করে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে আমি যখন চিৎকার দিব দিব ভাব ঠিক সেই মূহুর্তেই ট্রেন হুইসেল দিয়েছিল। তা না হলে হয়তো ভয়ে প্রাণফাটা আর্তচিৎকার দিয়ে লঙ্কাকান্ড বাঁধিয়ে ফেলতাম।

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *