ভূতুরে বড়ই গাছ

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৯ সালের অগ্রাহায়ন মাস। ধান কাটা শুরু হয়েছে। বাড়ি বাড়ি নতুন ধানের মাড়াই চলছে। সন্ধ্যার পরে চাঁদনী রাত থাকায় আমাদের বাড়িতেও দুই দাউন* গরু দিয়ে ধানের মলোন* দেয়া হয়েছে। আমার বড় মামা বেড়াতে এসেছেন। আমরা তিন ভাইবোন কাচারী ঘরে পড়তে বসেছি। হঠাৎ আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বে চিৎকার চেচামেচির শব্দ– কে আছো গো, তাড়াতাড়ি আগাও গো, মানুষ মরে গেল গো – — -।

বড় মামা উঠানে বসে বড় ভাইয়ের সাথে গল্প করছিলেন। চিৎকার শুনে মামা দ্রুত আমাদের পড়ার টেবিল থেকে হ্যারিকেন নিয়ে দক্ষিণ দিকে দৌড়াতে লাগলেন। মামার সাথে আমরাও পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগলাম। বাড়ি থেকে তিন চার শ’ গজ দূরে রাস্তার উপরে একটি গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গরুর গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে একটি লোক আর একটি মেয়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিল্লাচিল্লি করছে। আমরা কাছাকাছি যেতেই লোকটি আমাদের সাথে নিয়ে বড়ই গাছের দিকে দৌড়ে গেল। রাস্তা থেকে অল্প দূরেই বড়ই গাছ। গাছের নিচে নতুন শাড়ি পরিহিতা অল্প বয়স্কা তরুণী চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। হুশ নেই, অচেতন। মামা অজ্ঞান মহিলাকে ধরার জন্য বার বার গাড়োয়ানকে অনুরোধ করলেও গাড়োয়ান ধরতে রাজি হচ্ছে না। মামা তরুনীকে ধরার জন্য যতই ধমক দিচ্ছেন গাড়োয়ান ততই অনুরোধ করে বলছে আমি তার ভাসুর, আমার ধরা যাবে না।

ভাসুরেরা শত বিপদেও ছোট ভাইয়ের বউয়ের গায়ে হাত দিতে পারবে না, এমন নিয়ম বাংলার গ্রাম গঞ্জে চালু থাকায় লোকটি চিৎকার চেচামেচি করলেও মরানাপন্ন ছোট ভাইয়ের বউকে ধরে উঠানোর চেষ্টা করে নাই। সেই সময়ে ভাসুরেরা এই নিয়মটি বেদ বাক্যের মতই পালন করতো, বর্তমান ভাসুরেরা কি করবে জানিনা? তবে এলাকার আঞ্চলিক নিয়ম মেনে গাড়োয়ানের দাঁড়িয়ে থাকাটা সামাজিক নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধই বলা চলে। মামা ছোট ভাইয়ের বউ এবং ভাসুরের বিষয়টি বুঝতে পেরে বাধ্য হয়ে নি্েজই মেয়েটির মাথা ধরে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরাতে পারলেন না। এমন কি দাঁতে দাঁত লেগে গেছে দাঁতও খুলতে পারলেন না। অগত্যা আমার বড় ভাই এবং মামা মহিলাকে অজ্ঞান অবস্থায় ধরাধরি করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলেন। বাড়ির উঠানে জল চৌকির উপর শোয়ায়ে মা মাথায় পানি ঢাললেন। কয়েক কলসি পানি ঢাললেও জ্ঞান ফিরে এলো না। মেয়েটির বাবার বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামে। মেয়ের বাড়িতে খবর পাঠানো হলো। মেয়ের বাবা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। মেয়ের বাবাসহ উপস্থিত যারা ছিলেন তারা যে যতটুকু টোটকা চিকিৎসা জানে তা প্রয়োগ করেও মেয়ের জ্ঞান ফিরাতে পারলেন না। অবশেষে রাতেই কবিরাজ ডেকে আনলেন। কবিরাজ এসে রুগীর অবস্থা দেখে ভূতের চিকিৎসা করতে লাগলেন। চিকিৎসার এক পর্যায়ে জ্ঞান ফিরে এলো। তরুনী শোয়া অবস্থায় বড় বড় চোখ করে তাকালেন।
একটু পরে কবিরাজ তাকে শোয়া থেকে উঠে বসালেন। তরুনী একটা পর্যায়ে নাকি নাকি সুরে কথা বলা শুরু করলেন। কবিরাজ নাম জিজ্ঞেস করলেন। তরুনী নাম বললেন তবে নিজের নাম নয় ভুতের নাম। ভূতের নাম আয়তন্নেছা। কবিরাজ রুগী ছেড়ে চলে যেতে বললেন, কিন্তু ভূত ছেড়ে যেতে রাজী নয়। বাধ্য হয়ে কবিরাজ বাঁশের ঝাড় থেকে কাঁচা বাঁশের কঞ্চি কেটে এনে মন্ত্র পড়ে রুগীর পিছনে উল্টা দিকে মাটিতে পিটাতে লাগলেন। মাটিতে পেটন দিতেই ভূত চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল কিন্তু চিৎকার চেচামেচি করলেও রুগি ছেড়ে যেতে রাজী হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা তদবীর করার পর ভুত এলাক ছাড়তে বাধ্য হলো। ভুত যাতে আর না আসে তার জন্য কবিরাজ সাহেব পানি পড়া, তেল পড়া, তাবিজ-কবজ অনেক কিছু দিলেন। কবিরাজের চিকিৎসায় মেয়েটি এযাত্রা সুস্থ্য হলো।

নববধুর এই অবস্থা দেখে ভাসুর নাইওরী না নিয়েই খালি গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। যাওয়ার সময় মামা লোকটিকে জিজ্ঞাস করলেন, মেয়েটি কেমন করে বড়ই গাছের নিচে পড়ে গেল? ঘটনা সম্পর্কে মেয়ের ভাসুর যা বললেন তা হলো এই, এক মাস হলো মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর আচার অনুষ্ঠান সব পার হয়েছে। বিয়ের পরে মেয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। নতুন বউ নেয়ার জন্য তার ছোট বোনকে সাথে নিয়ে এসেছে। নিজেদের গরুর গাড়ির নিজেই গাড়োয়ান। বিকাল বেলা নাইওরী নিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু খাওয়া দাওয়া করে বিদায় নিতে নিতে রাত হয়ে যায়। গরুর গাড়ির উপরে চাটাই দিয়ে সুন্দর করে ছৈ দেয়া। ছৈয়ের পিছনে ফাঁকা জায়গা শাড়ী কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। ছৈয়ের সামনে ছোট বোন এবং পিছনে নতুন বউ। ছৈয়ের বাইরে সামনের দিকে ভাসুর গাড়োয়ান হয়ে গরু তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বড়ই গাছের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ গাড়ি ঝাঁকি দিয়ে উঠে। ভাসুর তার ছোট বোনকে গাড়ি ঝাঁকি দেয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলে, ভাবী গাড়ি থেকে লাফ দিয়েছে। বাম দিকে তাকিয়ে দেখে শাড়ীর আঁচল ছড়ানো অবস্থায় নতুন বউ বড়ই গাছের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। গাছের তলে গিয়েই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। এই অবস্থা দেখে সে ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়।

এই ঘঠনার ঠিক সাতদিন পড়ে আমরা সন্ধার সময় পড়ার ঘরে পড়তে বসেছি। মামাও আমাদের সাথে বসে আছে। এমন সময় বাড়ির দক্ষিণ পার্শ্বের ঐ জায়গা থেকেই তিন চারটি কণ্ঠে চিৎকার শোনা গেল। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে মামা এবং আমাদের বাড়ির দুই চাকর দৌড়ে গেল। গিয়ে দেখে বড়ই গাছের নিচে আবার সেই মহিলা পড়ে আছে। গাড়োয়ান সেই মহিলার ভাসুর। সাথে আরো দু’টি মেয়ে। মামা এবং আমাদের বাড়ির চাকর এন্তাজ ভাই ধরাধরি করে মহিলাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলো। জলচৌকির উপর শোয়ায়ে কেউ মাথায় পানি ঢালে, কেউ তেল পড়া দেয়, কেউ নাকে মরা গরুর হাড্ডি আগুনে পুরে ধরে। ইত্যাদি করতে করতে একসময় মেয়ের হুশ হলো। হুশ হওয়ার পরপরই মেয়ের বাড়ি থেকে মেয়ের বাপ মাসহ কয়েকজন চলে এলো। মেয়েকে এই অবস্থায় ভাসুর নিয়ে যেতে চাইলেও মেয়ের মা মেয়েকে পাঠাতে রাজী হলো না। অগত্যা গরুর গাড়ি আমাদের বাড়ি থেকেই নাইওরী ছাড়াই ফেরত গেল।

আরো কিছুদিন পরের ঘটনা। ঐ মেয়েকে আবার নাইওর নিতে এসেছে ঐ ভাসুর। সেদিনের সেই দশ বছরের মেয়েটির সাথে আরও একটি মধ্য বয়সী মহিলাও এসেছে। ছৈয়ের ভিতর নতুন বউকে মাঝখানে বসিয়ে সামনে দশ বছরের মেয়ে এবং পিছনে মধ্য বয়সের মহিলা নতুন বউয়ের চুল ধরে আছে। দুইজনেই সতর্ক যাতে নতুন বউ লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যেতে না পারে। ঠিক বড়ই গাছের কাছে আসার সাথে সাথে চুল ধরা অবস্থায় নতুন বউ কিভাবে লাফ দিয়ে নেমে গেছে মহিলা এবং মেয়েটি কিছুই বলতে পারে না। নামতে গিয়ে যখন গরুর গাড়ি ঝাঁকি খেয়েছে তখন দুইজন চিৎকার দিয়ে উঠেছে, ভাই, বউ গেল, বউ গেল। নতুন বউ এক দৌড়ে বড়ই গাছের নিচে যেতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। পরপর তিনদিন এই ঘটনা ঘটায় বড়ই গাছটি ভুতুরে গাছ হিসাবে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে বড়ই গাছটির নাম হয় আয়তন্নেছা ভুতের বড়ই গাছ।

এই ঘটনা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। গাছের মালিক ক্ষেতওয়ালাও ভয় পেয়ে যায়। গাছ কাটার ইচ্ছা থাকলেও ভুতের ভয়ে কাটার সাহস পায় না। গাছ কাটলে কি জানি ভূতে আবার ক্ষতি করে বসে! গাছওয়ালা গাছ না কাটলেও দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পরে বড়ই গাছটি এমনি এমনি মরে যায়।

এই ভুতের আছড়ওয়ালা বউকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন আর নিতে আসেনি। কয়েক মাস পরে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। ডিভোর্স হওয়ার পর মেয়ের বাবা মেয়েকে অনেক দিন আর বিয়ে দেয়নি। অনেক চিকিৎসা করার পর ভূতের আছড় থেকে মুক্ত করার পর অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়েছে।

ঘটনাটি আমার জীবনের বাস্তব ঘটনা। কয়েক মাস আগে হঠাৎ ঘটনাটি মনে পড়ে গেল। গাঁয়ে গিয়ে সেই মহিলার খোঁজ করতেই তার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। মহিলা এখনও বেঁচে আছেন। সন্তানাদি বড় হয়ে নাতিপুতি হয়েছে। তবে এখন আর সেই ভুতের আঁছড় নেই।

* দাউন = ধান মাড়াই করার জন্য বিশেষ কায়দায় তৈরী যে রশিতে গরুগুলোকে আটকানো হয় সেই রশির নাম দাউন। দুই দাউন অর্থ হলো দুই সারিতে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা। এক সারি গরু সামনে আরেক সারি গরু পিছনে থাকে।
* মলোন = গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা।

(ছবি ঃ ইন্টারনেট)

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *