দগ্ধ হৃদয় (সপ্তম র্পব)

ইসহাক আলী প্রামানীক

কয়েক দিন গত হয়েছে। অনেক রাত, বাড়ী বাড়ী অনেকেই ঘুমে কাতর। আবার কেউ ঘুমাতে যাচ্ছে। ইনামুল খাওয়া শেষ করে ঘুমাতে না গিয়ে ঘর থেকে বেড় হয়ে পড়লো। ইনামুল প্রায় দিনই হাসিনার বাড়ীতে অন্তত একবার করে দেখা করতে যেত। কেউ তাকে তাদের বাড়ী যেতে কখনও বাধা দেয়নি। তাই তার সেখানে যেতে কোন ভয় নেই। তাই এক পা-দু পা করে হাসিনার বাড়ীর দিকে রওনা হলো। সে চিন্তা করতে লাগলো হাসিনা পূর্বে তেমন কথাই বলতো না। আর এখন বেশ কথা বলতে শিখেছে। সেদিন রাতে হাসিনার কথা ও ব্যবহারে ইনামুলের মন খুবই প্রফূল্ল হয়েছে। সেদিনের কথা ও রসিকতায় মনটা আনন্দে ভরে উঠেছে।
সে আরো চিন্তা করতে লাগলো হাসিনাকে অনেক দিন থেকে ভালোবাসে। কিন্তু কেউ কাউকে মনের কথাটি খোলাখুলি বলতে পারেনি। শুধু চিন্তা হতো কবে কি ভাবে ভালবাসার কথা উভয়ের মাঝে প্রকাশ পাবে। কিন্তু চিন্তার পাহাড়টি হাসিনার কথার মাঝেই সামান্য হয়েছে।
হাসিনা এখন ষোড়শী যুবতী। এখন সে সাবালিকা যৌবন তরঙ্গ মালা উথালের পথে। তাই হাসিনার মনে অনেক দিনের চাপা ভালবাসা জেগে উঠতে শুরু করেছে। আর ইনামুলকে ভাই ছাড়াও মনে মনে অন্তরঙ্গ করার কথা ভাবতে ছিল। তাই সে মৃদু মৃদু হাসিতে তাকে রসিকতায় ভরে দিত।
হাসিনা ভাবতেছিল কিভাবে তাকে ভালবাসার আহ্বান জানাবো। যাক কথারচ্ছলে সে পর্ব সমাপ্ত হয়েছে বলে হাসিনাও খুশী। যাক উভয়ের মনের গভীরে লালিত স্বপ্ন প্রকাশিত হওয়ায় উভয়েই খুশী।
হাসিনা নিজেই ইনামুলকে বলেছে আপনাকে আমার খুব ভাললাগে॥ আপনাকে না দেখলে আপনার কথা না শুনলে আমার খুবই অস্তির লাগে ॥
এ কথায় এনামুল বললো সত্যি হাসিনা তোমাকে ছাড়া আমারো কোন ভালো লাগে না । তোমার কথা মনে করেই আমি কলেজ ছেড়ে এসেছি ॥ আমার মন জুড়ে শুধু তুমি ॥ বাড়ী আসলে তোমাকে ছেড়ে আর যেতে ইচ্ছা করে না।
এতো সব চিন্তার মাঝে এক সময় হাসিানার ঘরের সামনে এসে দাড়ালো। দেখলো হাসিনা যেন তার অপেক্ষায় বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। সেদিন অমাবস্যা ছিলনা বটে, কিন্তু আকাশে চাঁদ ছিল না ॥ তারকা রাশি মিটমিট করে জ্বলছিল, পাড়ার সবাই ঘুমালেও হাসিনার মায়ের ঘরে তখনও আলো জ্বলছিলো। হয়তো সে কোন কাজ করছিলো। কিন্তু তার মাকে ইনামুলের কোন ভয় নেই। কারণ তারাই ইনামকে যখন তখন এ বাড়ীতে আসতে শিখিয়েছে। তাই সে কোন সংকোচ বোধ করে না এ বাড়ী যাতায়াতে। তাই বারান্দার দিকে লক্ষ্য করে বললো, কে হাসিনা,
-হ্যা আমি।
-কি ব্যাপার ওখানে দাড়িয়ে কেন?
-আপনার আগমনের অপেক্ষায় ।
-আমিতো বলিনি যে আজ আসব ।
-না বললেও মন বলেছে, আপনি আসবেন ॥
-তাই নাকি ॥
-জ্বী হা ॥ আমার মন যে এখন চিন্তাশীল ॥
-ঠিক আছে চলো
-কোথায় যাবো ?
-ঐ কাঁঠাল গাছের তলে, ওইখানে বসে কিছু কথা বলে নেই, চলো ॥
-কিন্তু মা যদি খোজে ?
-কোন ভয় নেই ॥ চাচী আম্মা আমাদের প্রতি কোন সন্দেহ করবেন না। বুঝলে তো-
-আপনি জানেন কি করে ?
-বারে ? জানবো না ॥ ছোট বেলা থেকে তার কাছে প্রায় মানুষ হয়েছি। সে আমাকে যেমন বিশ্বাস করেন আমিও তার উপর তেমনই বিশ্বাস রাখি।
-তা হলে চলো যাই।
উভয়ে কথা বলতে বলতে গাছের নীচে এসে বসলো॥ অন্ধকার রাত হলেও ঝলমল তারার আলোয় চারি পাশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাসিনা হঠাৎ দাড়িয়ে পড়লো।
-কি ব্যাপার দাড়ালে যে !
-না অন্ধকার রাতে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না তাই।
-আরে কোথায় অন্ধকার দেখছো। আমি তো দেখছি পুর্ণিমার রাত।
-তার মানে কোথায় পূর্ণিমা রাত। আজ পূর্ণিমার পর চার প্রহর যাচ্ছে॥
-ধ্যাত কিছুই বোঝনা ॥ তোমার রূপের ছাটার তো পূর্ণিমার ঝলমল করছে॥ আর তোমার হাসিতে ছুটছে তারার আলো ॥ তোমার শরীর যেন আলোকিত বস্তু। এরফলে গাছপালা ফুল ফল আকাশের তারা সব যেন নিজকে ধন্য মনে করছে। চলো তোমার বাগানের সামনে গিয়েই বসি। তবে সত্যি যদি আজ পূর্ণিমা রাত্রি হতো তবে আমাদের সান্ধ্যিটাও ধন্য হতো।
তারপর তারা বাগানের সামনে বসে কিছুক্ষণ মধুর আলাপে কাটিয়ে দিল। হাসিনার ভয় হতে লাগলো যদি কেউ দেখে ফেলে তবে নিস্তার নেই। তাই সে বললো।
-এই চলুন আমরা উঠি।
-কেন ? বেশতো আছি।
-না আমার সন্দেহ হচ্ছে কেউ দেখছে। রাত অনেক হলো। তাছাড়া মনে হচ্ছে কেউ আমাদেরকে দেখছে ? কাল না হয় রাতে আবার আলাপ হবে। তাছাড়া চাঁদ উঠে গেছে॥ চার দিকে ঝলমল করছে। এখন আমাদের যাওয়াটাই সৌভাগ্যের।
-ঠিক আছে চলো।

তারপর ধীরে ধীরে উভয়ে হাসিনার কামড়ায় প্রবেশ করলো। কিন্তু কিছু একটা চিন্তা করে ইনামুল ঘর থেকে বেড় হয়ে যেতে থাকলো ॥ তখন হাসিনার মা বললো কি বাবা তুমি বসলে না যে।
-না চাচী আম্মা এখন আর বসবো না রাত অনেক হয়েছে এখন শুতে যাবো।
-তা কখন এসোছিলে বুঝতে পারিনি।
-কিছুক্ষণ পূর্বেই চাচী আম্মা।
-তা ঘরে ঢুকে অমনি বেড়িয়ে পড়লে একটু বসে যাও।
-না চাচী আম্মা এখন আর বসি না। এই বলে সে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।

একটু পরেই হাসিনার চাচা করিম মিয়ার গলার স্বর শুনা গেল। সে হাসিনার মায়ের কামড়ায় গেলেন। হাসিনার মা তাকে দেখে ভাবতে লাগলেন এ কেন অসময়ে ঘরে এলো। কয়েক দিন হলো তো উনার পায়ের ধুলা আমার আঙিনায় পরে নাই। তবে কি ও কোন জমিজমা বিষয়ে আলোচনা করতে চায় না কোন জমি বে-দখল নিতে চায়, ইত্যাদি সে ভাবতে লাগলো। যতদিন তার স্বামী বেঁচে ছিল ততদিন তার সম্পত্তিতে হাত দিতে সাহস করেনি। আজ স্বামী নেই আর সম্পত্তির পিছনে উঠে পরে লেগেছে। সে এক বিঘা নিয়েছে চিকিৎসার খরচ বাবদ, আর তিন বিঘা নিয়েছে খাজনা খারিজ বাবদ। না জানি আজ কোন অজুহাতে আবার কি চাইবে কে জানে ? হাসিনার মা এসব চিন্তা করে নিল।
-কিছুক্ষণ পর করিম ঘরে প্রবেশ করে জিজ্ঞাসা করে বললো কে এসেছিল ভাবী?
-কেন ? এনামুল এসেছিল?
-তা এতো রাতে কিসের জন্য
-এমনি এসেছিল। প্রায়ই আসে তাই।
-তা রাতে কেন ?

করিম সাহেব সর্বদা চেচিয়ে কথা বলতো। কিন্তু আজ সে ন¤্রসুরে কথা বলছে। তার কথার ধরণটাই কেমন যেন অন্য ধরনের। কিন্তু তার প্রত্যেকটি কথাতেই যেন কিসের গন্ধ মিলছে। কথা সুরে আর গদ গদ রাগ রাগ ভাব। আমিতো ইনামুলকে ছোট থেকেই নিজের ছেলে বলেই বিশ্বাস করি। আজ আবার সে এমন কি করল যে তার উপর এতরাগ। ভয়ে ভয়ে সে বললো-কেন সেতো সর্বক্ষণই আসা যাওয়া করে। ইনামুল কি আজ কোন দোষ করেছে।
-আপনার কি চোখ নেই ভাবী। আপনি দেখতে পাননা। আপনি প্রশ্রয় দিয়ে ঘরে শয়তান ডেকে আনছেন। বলি মেয়েকি এখন আপনার ছোটটি রয়েছে, যে রাতের অন্ধকারে গাছের তলায় ঘুরে বেড়াবে। আরেক দিন ওদের দুজনকে বারান্দায় অন্ধকারে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছি। সেদিন মনে করেছিলাম হয়তো দরকারী কথা বলতে এসেছে, কিন্তু আজতো ওদেরকে গাছের তলা থেকে আসতে দেখলাম-এটা কি হচ্ছে ভাবী। মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে না ঘরে আইবুরো করে রাখবেন।
হাসিনার মা হতবাক হয়ে গেলেন করিমের মুখে এসব শুনে। সে কিছুই বলছেন না।
-কি কথা বলছেন না কেন?
-আমি কি বলব ॥ আমি এসব জানিনা।
-শোনেন হাসিনাকে আজ থেকে নিষেধ করে দিবেন ওযেন এভাবে চলাফেরা না করে। ইনামের যদি কিছুর দরকার থাকে তবে যেন সে দিনের বেলায় আসে, বুঝতে পরলেন। পরে কিন্তু মেয়েকে নিয়ে ফ্যাসাদে পড়বেন। যুবতী মেয়ে তাকে এখনও ছেলেদের মতো স্বাধীনতা দিচ্ছেন কেন? আপনার কি সে সব বিষয়ে কোন জ্ঞান আছে? আজকে বলে যাচ্ছি আর কোন দিন যদি আজকের মত বেলেল্লাপনা চোখে পরে তবে, জবাই করে বস্তায় তুলে নদীতে ফেলে দেবো। পরে কাঁদতে পারবেন না। সাবধান হয়ে যান। পরে যেন মানুষের কানাঘুষা করতে না শুনতে হয়। শেষে মুখ দেখানো মুস্কিল হবে। এই বলে করিম মিয়া বেড় হয়ে গেল।
করিমের এতগুলো কথায় হাসিনার মা একটারও জবাব দেয় নাই। কারন এসব কথার কোন জবাব তার কাছে ছিলো না। ওদিকে হাসিনা তার কক্ষ হতে সব কথাই সে শুনতে পায়। চাচার কথা শুনে সে ভয় পেতে ছিল। কারণ তার সন্দেহ হয়েছিল কে যেন তাদেরকে লক্ষ্য করতেছে আড়াল থেকে। তাই সে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। হাসিনার যেন চাচার কথায় লজ্জা করতে লাগলো। আমাকে যদি ইনামের সাথে আর কোন দিন দেখে তবে নিশ্চয় মেরে ফেলবে। চাচার যে রাগ সে কখনো আমাদেরকে ক্ষমা করবে না। তার শরীর মন কাপতে থাকলো। সকালে হতো চচাকে মুখ দেখানো যাবে না। এমন সময় হাসিনার মা এসে বলতে লাগলো হতভাগী এসব কি শুনলাম। বলি কলঙ্খের বোঝা কে বইবে। ভাল যদি চাস যে কয়দিন বিয়ে না হয় সে কয়দিন মুখ বুঝে ঘরে বসে থাকবি? যদি এধরনের কথা আর কোন দিন শুনি তবে হয় তোকে বস্তায় তুলবো না হয় আমি নিজেই গলায় দড়ি দিবো।
-মা ! তুমি কি বলছো ?
-হ্যা সত্যি বললাম। মরে গেলে ন্যাটা চুকে যায়। তবু আর পরের কথা শুনতে হবে না। আমি মনে করেছিলাম ছেলেটা ভালো এখন থেকে দুজনে ঊভয়কে বুঝে নিক। যাতে ভবিষ্যতে ওদের সংসার জীবনটা সুখের হবে । কিন্তু সমাজ আর করিমের তারনায় তার কোনটাই হবে না। আজকে বলে দিচ্ছি আর যেন কোন কথা শুনিনা। আজ থেকে তোর চাচাকে দেখে শুনে চলবি। তারপর হাসিনার মা চলে গেল। তখন হাসিনার মায়ের কথাতে মনের ভয়টা কমে গেল।
সে চিন্তা করতে লাগলো যে ভাবেই হোক ইনামুলের সাথে দেখা করে আজকের ঘটনা জানাতে হবে। না হলে যদি আবার আজকের মত করে আসে তবে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাছাড়া সেতো সব সময় বাড়ী আসে না। যখন কলেজ বন্ধ হয় তখন বাড়ী আসে। তাই এখনই জানাতে হবে বিষয়টি। নইলে যদি কলেজে চলে যায় তবে আর বলা হবে না। এখন চাচার নজর আমার দিকে যে। আমি এখন কিভাবে দেখা করতে পারি তার সাথে। বিভিন্ন চিন্তার মাঝে সে এক সময় ঘুমিয়ে পরে।

ওদিকে যখন ইনামুল ঘর থেকে বেড় হয়ে যাচ্ছিল তখনই করিম সাহেবের গলা শুনতে পায়। তাই থমকে দাড়িয়ে পরে ঘরে বাইরে। করিম সাহেবের উচ্চ বাচ্য সব ধরণের কথাই তার কানে যায়। সেও কঠিন চিন্তায় পড়ে গেল। অন্য কোন লোক দৃশ্যটি দেখে নাই, দেখেছে বাঘে। এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া মুস্কিল। অন্য কোন লোক দেখলে কিছু হতো না। আর সে দেখে ফেলেছে তাকে আর ধুলা দেওয়া যাবে না। সে ইনামুল কে ছোট বেলা থেকে ভাল বলে জানে। কিন্তু আজ সে মন্দ ভেবে বসল। তাই আর কোন দিন আজকের মত দেখলে সত্যিই হাসিনাকে জবাই করবে, আর আমাকেও বলে ছাড়বেনা আর যদি সমাজ জেনে ফেলে তবে বিচারে একশত ঘা বেত মারবে। আর এ সমাজের করিমই বড় মাতাব্বর, তার হাতেই আমাকে মার খেতে হবে।

সে যে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। অনেক দিনের সাধনায় কেবল বাস্তবায়নের পথ দেখেছিলো। আর অংকুরেই শেষ হয়ে যাবে তাতো হতে দেয়া যাবে না। যে ভাবে হোক হাসিনাকে আমার পেতেই হবে। তার জন্য অন্য আড়ালে আমাকে আমার কাজ করতে হবে। এতো সব চিন্তার মাঝে ঘরে এসে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে তা নিজেই জানে না।

চলবে —

(ছবি গুগোল)

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *