একাত্তরের এই দিনে

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের ছয় জনকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে ফুলছড়ি বধ্য ভুমিতে হত্যা করে। সেদিন তাদের ধরে নেয়ার দৃশ্যটি আজো আমি ভুলতে পারি নাই। মনে পড়ে ৩০শে এপ্রিলের কথা। সকাল বেলা ফুলছড়ি থানার দারোগা এসে গ্রামের সব মাতুব্বরকে ডেকে কালিরঘ্যাস নামক গ্রামের ছামচুল মেম্বারের বাড়িতে জড় করে। সেখানে গ্রামের অনেকেই গিয়েছিলেন। আমার বাবাকেও চৌকিদার এসে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। দারোগা চেয়ারে বসে ছিলেন আর গ্রামের মাতুব্বররা মাটিতে ধানের নাড়া বিছিয়ে বসে ছিলেন। দারোগা গ্রামের মাতুব্বরদের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রথমে আমার বাবার পিঠে লাথি দিয়ে ফেলে দেয়, এর পরপরই নিবারণ কাকাকে লাথি মারে। এভাবে পর পর কয়েকজনকে বেপোরোয়া লাথি মারায় উপস্থিত সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যে যেদিকে পারে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সবাই পালালেও একজনের ভাগ্যে পালানোর সুযোগ ঘটে নাই। তিনি হলেন নিবারণ কাকার বড়ো ভাই রোহিনী কান্ত সরকার। রোহিনী কান্ত সরকার পালানোর আগেই দারোগার হাতে ধরা পরে। উনি পেশায় একজন গ্রাম্য ডাক্তার ছিলেন। সেই সময় অত্র এলাকায় ইনিই একমাত্র এলোপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। তার চিকিৎসার উপরেই পুরো এলাকার মানুষের চিকিৎসা নির্ভর করতো। রোহিনী ডাক্তারকে ঐ নিষ্ঠুর দারোগা ধরে নিয়ে ফুলছড়ি থানায় চলে যায়। এরপর তার আর কোন খবর পাওয়া যায় নাই।

রোহিনী কান্ত সরকারকে দারোগা ধরে নেয়ার পর থেকে আর কোন খবর না পাওয়ায় গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সবাই জানের ভয়ে ফুলছড়ি থানা এলাকার আশেপাশে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তাছাড়া ফুলছড়ি এলাকাতেও কোন লোকজন নাই। সবাই এলাকা ছাড়া। বাঙালি দেখা মাত্রই যেখানে গুলি চলে সেখানে যাওয়ার সাহস দেখানোর প্রশ্নই আসে না। আমাদের এলাকার মানুষ তখনও গ্রাম ছাড়া হয় নাই। তবে এমতোবস্থায় কে কি করবে কোথায় পালাবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ডাক্তারকে ধরে নেয়ার আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই ঠিক তার পরদিনই ১লা মে সকাল বেলা দুই গাড়ি খানসেনা হঠাৎ গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় ঢুকে পড়ে। আকস্মিক ভাবে খানসেনারা গ্রামে ঢুকে পড়ায় অনেকে পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারে নাই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সবাই জান বাঁচানোর জন্য দিকবেদিক ছুটাছুটি করে পালানোর চেষ্টা করে। অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও কয়েকজনের ভাগ্যে পালানোর সুযোগ ঘটে নাই। তারা নরপিশাচ খান সেনাদের হাতে আটক হয়ে যায়।

খান সেনারা এসেছিল গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে আর আমাদের বাড়িটি ছিল গ্রামের পূর্বপাশে। আমাদের বাড়িটি গ্রামের পূর্ব পাশে হওয়ায় পাকসেনারা আমাদের পাড়ায় তখনো আসে নাই। আমার বাবা পাক সেনা গ্রামে ঢুকে পড়েছে এই খবর পেয়েই আমাকে কিছু জিনিষপত্র বস্তায় তুলে দিয়ে সাইকেল নিয়ে পালাতে বলে। আমার মাসহ ভাই বোনদের বাবা আগেই চর এলাকায় আমার ফুফুর বাড়িতে রেখে এসেছিলেন। আমি সাইকেলে বস্তা নিয়ে আমাদের বাড়ির পূর্ব পাশের ওয়াপদা বাঁধ পার হয়ে তিন চারশ গজ দূরে পাট ক্ষেতে ঢুকে পড়ি। বস্তাসহ সাইকেল পাট ক্ষেতের ভিতরে কাত করে ফেলে রেখে পাট ক্ষেতের আইলের নিচে উপর হয়ে শুয়ে পড়ি। শুয়ে পড়ার কারণ হলো– ২৬শে মার্চের পরে আমাদের গ্রামের তহশীল অফিসের মাঠে একদল ছাত্র মুক্তি যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ছিল, সেখানে যুদ্ধে কিভাবে গোলাগুলির হাত থেকে আত্মরক্ষা করা যায় তার কিছু কৌশল শিখানো হয়েছিল সেই কৌশল অনুযায়ী জমির একফুট উচু আইলের নিচে শুয়ে পড়েছিলাম।

পাট ক্ষেতে লুকানোর কিছুক্ষণ পরেই পাক সেনাদের দুইটি গাড়ি পশ্চিম পাড়া থেকে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে পূর্ব পাশের ওয়াপদা বাঁধে চলে আসে। ওয়াপদা বাঁধটি সরাসরি ফুলছড়ি থানার পাশ দিয়েই চলে গেছে। খান সেনারা পশ্চিমের রাস্তা দিয়ে গ্রামে ঢুকলেও যাওয়ার সময় রাস্তা পরিবর্তন করে পূবের রাস্তা দিয়ে যায়। ওয়াপদা বাঁধে এসে তারা আর কোন বাড়িতে হামলা করে নাই, কারণ তখন পুরো গ্রাম জনমানব শূন্য হয়ে গেছে। বাড়ি ঘর ফেলে রেখে যার যার জান নিয়ে যে যেদিকে পেরেছে পালিয়ে গেছে। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে আর কোন মানুষ খুঁজে না পাওয়ায় হয়তো তারা পূর্বের গ্রামে আর কোন হামলা করে নাই।

ওয়াপদা বাঁধে উঠেই গাড়ি কোথাও না থামিয়ে সোজা ফুলছড়ির দিকে চলে যায়। এতো বিপদের মধ্যেও উৎসুক মনকে ঠিক রাখতে পারি নাই। মাঝে মাঝে মাথা তুলে বাঁধের দিকে নজর রাখতে ছিলাম যদি খান সেনা এদিকে আসে তাহলে জান বাঁচানোর জন্য পাট ক্ষেত থেকে উঠে পূর্ব দিকে মানাস নদীর দিকে দৌড়াতে হবে। উঁকিঝুকি করতে গিয়েই পাট ক্ষেতের ফাঁক ফোকর দিয়ে যতটুকু দেখেছি তাতে পাকসেনাদের লড়ির উপরে এই পাঁচজন হাত বাঁধা অবস্থায় অসহায়ের মতো বসে ছিল। পাক সেনাদের গাড়ি দ্রুত চলে যাওয়ার সময় এক ঝলকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধরে নেয়া মানুষদের যে দৃশ্যটি দেখেছি তা আজো আমি ভুলতে পারি নাই। পাক সেনারা চলে যাওয়ার পর পাট ক্ষেত থেকে বের হয়ে দেখি ঐ পাট ক্ষেতে আমার বাবাসহ আরো অনেকে লুকিয়েছিল। একই পাট ক্ষেতে অনেকে আশ্রয় নিলেও টু শব্দটি না করায় কারো অবস্থান বোঝা যায় নাই। গ্রামের পাঁচ জনকে ধরে নেয়ার পর পুরো গ্রাম জুড়ে আতঙ্ক আরো ছড়িয়ে পড়ল। মুহুর্তেই পুরো গ্রাম ফাঁকা হয়ে গেল। হিন্দু মুসলিম সবাই চরে গিয়ে আশ্রয় নিল। এই ঘটনার পর আমাকে আর বাবা গ্রামে থাকতে দেয় নাই, সাইকেল নিয়ে সোজা চর এলাকায় পাঠিয়েছিল।

খান সেনাদের হাতে নিহত হওয়া এই ছয় জন হলো (১) রোহিনী কান্ত সরকার, যিনি পেশায় একজন গ্রাম্য চিকিৎসক ছিলেন। (২) প্রিয় নাথ সরকার কৃষক (৩) হরিদাস রাজভর, যাকে আমরা হলদিওয়ালা বলতাম অর্থাৎ হলুদের ব্যাবসা করতেন (৪) বরদা চরণ দাস, পেশায় একজন সচ্ছল কৃষক ছিলেন, কৃষি কাজের পাশাপাশি তিনি পাটের ব্যাবসায়ী ছিলেন এবং শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তার দেয়া জমিতেই ১৯৩০সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিংড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, যা এখনো বিদ্যমান আছে (৫) হীরা লাল দাস কৃষক ছিলেন, তার বাড়িটি ছিল আমাদের বাড়ির কয়েকশ’ গজ পিছনে (৬) বিজয় কুমার দাস, তিনি খুবই রসিক মানুষ ছিলেন, তার রসিকতার অনেক দৃশ্য আজও মনে পড়ে। (7) ক্ষিতিস চন্দ্র মন্ডল যার ডাক নাম ছিল ভিখারি মন্ডল

দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন দিয়েছে তাদের অনেকের নাম হয়তো ইতিহাসের পাতায় লেখা নাই। আমার গ্রামের বর্তমান প্রজন্ম অনেকেই এই নামগুলো জানে না। তাদের জন্যই আমার সেই সময়ের সংক্ষিপ্ত এই স্মৃতিচারণ, যাতে ইতিহাসে তাদের নাম লেখা না হলেও গ্রামের লোকগুলোর কাছে এই নামগুলো স্মরনীয় হয়ে থাকে।
(উপরের লেখাটি খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে লেখা। তবে ইচ্ছা আছে ১৯৭১সালে আমার দেখা কিছু স্মৃতিচারণ পর্যায়ক্রমে লেখার)

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *