হুদা ছালুনে ব্যাক্কেল

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

ডিসেম্বর মাসের শেষ পর্যায়। পকেটে পয়সা পাতির জোর কম থাকায় বিকালে অফিস থেকে হেঁটে বাসায় ফিরছি। গুলিস্থানের কাছে আসতেই আমাদের পাশের গ্রামের এক মুরুব্বীর সাথে দেখা। বয়স্ক মানুষ। গ্রামের ছোট খাটো মাতব্বরও বটে। তার সাথে আরো একজন বয়স্ক লোক, হয়তো আত্মীয়-স্বজন হবে। সামনে পড়তেই সালাম দিলাম। সালামের জাবাব দিয়ে আমাকে দেখেই মুরুব্বী খুশিতে আটখানা হয়ে গেল। আমাকে পেয়ে তার আনন্দের সীমা নেই। ঢাকা শহরের রাস্তায় আমাকে পাবে এটা তার কল্পনাতেই ছিল না।
হাসি দিয়ে বললাম, চাচা কেমন আছেন?
চাচা আমার চেয়েও দ্বিগুন হাসি দিয়ে বললেন, বাজান, খুব ভাল আছি।
তার ভাল আছি উত্তর শুনে বললাম, চাচা কোথায় যাচ্ছেন?
তিনি খুশি খুশিভাবে বললেন, মুºা পাড়া মেয়ের বাসায় বেড়াইতে আইছি। বিকাল বেলা ঢাকা শহরটা একটু ঘুইরা ঘুইরা দেখতেছি। তা বাজান তুমি কেমুন আছো?
মুখের হাসি হাসি ভাবটা বজায় রেখেই বললাম, ভাল আছি। বলেই গ্রামের কিছু কুশলাদি জিজ্ঞেস করে চা পানি খাওয়ানোর জন্য দুইজনকে সাথে নিয়ে হোটেলের দিকে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, গ্রামের মানুষ, ভাল কিছু খাওয়ানো দরকার, যাতে গ্রামে গিয়ে প্রশংসা করে, সেই মানসিকতায় গুলিস্থানের রাজধানী হোটেলে নিয়ে বসালাম। ওনারাও খুশি হয়ে বসল। জিজ্ঞেস করলাম, চাচা কি খাবেন?
মুরুব্বী বললেন, বাজান, যে হাইফাই হোটেলে নিয়া আইলা, খাইতে না জানি কত ট্যাকা লাগে! হুদাহুদি ট্যাকা খরচ করার দরকার কি? অল্প স্বল্পের মধ্যে কিছু খাইলেই হইবো।

পাশের টেবিলে একজন হালিম খাচ্ছিল। তাই দেখে মুরুব্বীকে বললাম, চাচা শাহী হালিম খাবেন?
শাহী হালিমের নাম শুনে মুরুব্বী আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার তাকানো দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। দু’মিনিট পরে বললেন, বাজান, শাহী হালিম নামডা তো খুব সুন্দর, খাইতে নিশ্চয় খুব সুস্বাদু হইবো। তা বাজান, খাইতে আবার অনেক ট্যাকা লাগবো না তো?
আমি হেসে বললাম, চাচা টাকার চিন্তা করেন কেন? আপনারা খাবেন কিনা সেইটা বলেন?
মুরুব্বী খুব খুশি হয়েই বললেন, ঠিক আছে চাচা, তাইলে এইডাই খাওয়াও। অনেক নাম শুনছি, কুনদিন খাই নাই। আইজকা খাইলে গ্রামে গিয়া তাও গল্প করবার পারমু, ভাতিজা আমাগো ঢাকা শহরে গুলিস্থানের বড় হোটেলে শাহী হালিম খাওয়াইছে।

মুরুব্বীর কথা শুনে খুব খুশিই হলাম। অনেক টাকা পয়সা খরচ করেও মানুষের প্রশংসা পাওয়া যায় না। সামান্য হালিম খাইয়ে যদি গ্রামে সুনাম অর্জন করতে পারি তা মন্দ কি! আনন্দে বিগলিত হয়েই তিন বাটি হালিমের অর্ডার দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, কিছু টাকা খরচ হয় হোক, তবু লোকগুলো হালিম খেয়ে তৃপ্তিবোধ করলে তাতে আমারো আত্মতৃপ্তি।

বয় তিন বাটি হালিম নিয়ে এলো। তাদের সামনে দুই বাটি দিয়ে আমি এক বাটি নিলাম। বাটিতে দেয়া চামুচ হাতে নিয়ে আদা কুচি, পিয়াজ ভাজা আর ধনিয়ার পাতা কুচিগুলো একত্রে মিশিয়ে বাটিতে হালিম ঘাটতে ঘাটতে বললাম, নেন চাচা খাওয়া শুরু করেন।
মুরুব্বী খুব খুশি হয়ে হাতে চামুচ নিয়ে আমাকে ফলো করতে ছিল। অর্থাৎ শাহী হালিম কিভাবে খেতে হয় সেটা তার ধারনা না থাকায় আমার দেখাদেখি আমার মত করেই হালিম ঘেটে পিয়াজ ভাজা, আদা কুচি, ধনিয়ার পাতা হালিমের সাথে মিশিয়ে নিল। আমার সাথে সাথে অল্প অল্প করে চামুচে তুলে মুখে দিতে লাগল। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে জীবনের প্রথম হালিম খাওয়ার পরিতৃপ্তির চিহ্ণ খুঁজতে ছিলাম। কিন্তু হালিম খেয়ে মুরুব্বির মুখে তৃপ্তির লক্ষণ তো দূরের কথা কিছুটা অতৃপ্তির ছাপই লক্ষ্য করলাম। কয়েক চামুচ খেয়ে বলল, ভাতিজা এইডা কি আসলেই শাহী হালিম?
বললাম, জী চাচা, এইটা ঢাকা শহরের নামকরা শাহী হালিম।
মুরুব্বী চামুচ পিরিচের উপর রেখে বলল, ভাতিজা আমারে কি বোকা বানাইলা নাকি?
বললাম, কেন চাচা?
মুখটা ব্যাজার করে বলল, দুই টুকরা মাংসের মধ্যে এক খাবলা গমের আটা মিশাল কইরা পাক করা পিঠালী মার্কা হুদা ছালুন খাইতে দিয়া কইতেছো শাহী হালিম।

চাচার কথা শুনে কিছুটা বোকা বোনে গেলাম। বললাম, না চাচা, এটা হুদা ছালুন না। এটা ঢাকার বিখ্যাত শাহী হালিম। এইটা নবাব বাদশারা আগে খেত এইজন্য এইটার নাম হয়েছে শাহী হালিম।
চাচা ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে বলল, ধুর ভাতিজা, আমারে কি ব্যাক্কল পাইলা নাকি!
আমি মুরুব্বীর এরকম ধমকের কোন অর্থ খুঁজে পেলাম না। মুরুব্বীকে স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, চাচা বলেন কি, আপনারে ব্যাক্কল পাবো কেন? আপনার বিশ্বাস না হলে পাশের টেবিলে খাচ্ছে তাকে জিজ্ঞেস করেন?
মুরুব্বী মুখ বাঁকা করে বলল, আরে বাবা গ্রাম থিকা আইছি দেইখা আমি এত ব্যাক্কল না। এরকম ছালুন আমরা গ্রামের মজলিশে ভাত দিয়া কত খাই। আমাগো গ্রামের মুসলিম বাবুর্চির আটার পিঠালীও এর চায়া অনেক স্বাদ। ছালুনে নুন হয় নাই, ঝাল হয় নাই, হেই হুদা ছালুন খাইতে দিয়া কইতেছো শাহী হালিম। ধুর! ভাতিজা ধুর!! আমারে পুরাই ব্যাক্কল বানাইলা।

মুরুব্বীর কথা শুনে নিজের খাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। তিন বাটি হালিম এমনি এমনিই পড়ে থাকল। উপায়ন্তর না দেখে হালিম রেখে চায়ের অর্ডার দিয়ে চা খেয়ে হোটেলের বিল পরিশোধ করে বাইরে চলে এলাম। তাদের দুইজনকে বিদায় দিয়ে মনে মনে বললাম, শাহী হালিমের গুষ্টি কিলাই, টাকাও গেল, মানসম্মানও গেল, হুদা ছালুনের বদনামও হলো। জীবনে বেঁচে থাকতে গ্রামের কোন বুড়াধুরা মানুষকে শাহী হালিম খাওয়ানো তো দূরের কথা হালিমের নাম মুখেও আনবো না।

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *