হাগড়া পাতার ছালুন (রম্য গল্প)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

ঢাকার চার দেয়ালে আটকে থাকা এক ঘেয়েমি জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১৮ বছর পর ঢাকার অদূরে এক ছাত্রের বাড়ি বেড়াতে গেলাম। প্রথম দেখায় ছাত্রের বাবার চিনতে দেরি হলো। না চেনার কারণও আছে। অনেক দিন পর গিয়েছি তারোপর ষাটের কাছাকাছি বয়স, চুল, দাড়ি পেকে চোখের পাওয়ার কমে বুড়োর খাতায় নাম দিয়েছেন। এদিকে আমিও বয়সের কারণে চুল পেকে আধা বয়সি হয়েছি, চেহারা শ্রুতের অবস্থা আগের মত নেই যে কারণে  প্রথম প্রথম চিন্তে তার কষ্ট হওয়ারই কথা। কিন্তু ছাত্রের বাবার চিনতে দেরি হলেও ছাত্রের মায়ের চিনতে দেরি হলো না। মনে হয় পাশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে এসে আমাকে দেখেই  চিল্লিয়ে উঠলেন, আরে স্যার আপনি!! আপনি কোইত্থিকা আইলেন?

এনারা যখন ঢাকায় ছিল তখন তাদের বড় ছেলেকে তিন বছর পড়িয়েছি। অনেক দিন হলো ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেছেন, এর মধ্যে আমার সাথে তাদের আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই। আমার সেই ছাত্র এখন ঢাকায় চাকরী করে। বিয়ে শাদী করেছে। দীর্ঘদিন তাদের সাথে যোগাযোগ ছিল না। এতদিন পর দেখা করতে এসে দ্বিধা দ্বন্দে ছিলাম। যদি চিনতে না পারে তবে আহাম্মক হয়ে ফিরতে হবে। কিন্তু ছেলের শিক্ষক হিসাবে এখনও তারা আমাকে মনে রেখেছে, প্রথম দেখাতেই চিনতে পারায় আমি খুব খুশিই হলাম। হাসি হাসি মুখে বললাম, ঢাকা থেকে এসেছি।

ছাত্রের মায়ের কথায় ছাত্রের বাবার হুশ হলো। এবার তিনি চিনতে পেরে বারান্দার চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। উঠানে এসে আমার ডান হাত চেপে ধরে ঘন ঘন ঝাঁকিয়ে প্রথমে না চিনতে পারাটা যেন তার অপরাধ হয়েছে এমনই ভাব প্রকাশ করতে লাগলেন। ছাত্রের বাবার মনে অপরাধবোধ হওয়ার কারণও আছে। এই গ্রামে কিছু জমি কেনার সময় আমি তার সাথে ছিলাম। তিনি অল্প লেখাপড়া জানলেও জমি সংক্রান্ত মুহুরীদের হাতের লেখা দলিল পড়তে পারতেন না। তার এই বিষয়গুলো নিয়ে কাচারী পর্যন্ত তার সাথে আমাকেও যেতে হয়েছিল। তার সাথে কাচারি পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করার অবদানের জন্য তিনি আমাকে যথেষ্ঠ স্নেহ করতেন। নিজের ছোট ভাইয়ের মতই আদর করতেন। প্রথম দেখায় আমাকে চিনতে না পারায় তিনি যেন ব্যাথিত হয়েছেন বলে মনে হলো। চিনতে পেরে আমাকে উঠান থেকে টেনে নিয়ে ঘরে বসতে দিলেন। ঘরে চৌকির উপর বসতে না বসতেই ছাত্রের মাকে হুকুম দিলেন, এই শাজানের মাও তাড়াতাড়ি স্যারেরে নাস্তা দাও।

ছাত্রের বাবার অর্ডার দিতে দেরি হলেও ছাত্রের মায়ের নাস্তা আনতে দেরি হলো না। নাস্তা তাদের ঘরেই ছিল। প্লেট ভর্তি করে চিড়া, মুড়ি, গুড় নিয়ে এলেন। সদ্য গাই দোয়ানো এক বাটি গরম দুধও পাতে ঢেলে দিলেন। গ্রামের সহজ সরল মানুষের এরকম আতিথেয়তার তুলনা হয় না। তারা সাধ্য অনুযায়ী যা খাওয়ায় তা অন্তর থেকেই খাওয়ায়। শহরের দামী খাবারের চেয়ে গ্রামের মানুষের আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন করা এইসব খাবারের তুলনাই হয় না। আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন করা সামান্য মুড়িটাও মধুর মত লাগে।

আমার সাথে ছাত্রের বাবাও খেতে বসলেন। চিড়া মুড়ি খেয়েই পেট ভরে গেল। এর পরে দুপুরে খাবারের প্রয়োজন হবে বলে মনে হলো না। কিন্তু খাওয়া শেষে আলাপ আলোচনার পর ঢাকায় ফেরার জন্য বিদায় নেয়ার কথা বলতেই ছাত্রের বাবা ধমক দিয়ে উঠলেন, অনেক দিন পর আইছেন, ভাত না খায়া যাইতে চাইলেই আমরা যাইতে দিমু। দুপুরের ভাত না খায়া এক পাও নড়তে পারবেন না।

তাদের আদর আপ্যায়ন সম্পর্কে আমার অনেকটা ধারনা আছে। ছেলেটিকে তিন বছর পড়িয়েছি। তখনও তারা আমাকে যথেষ্ঠ আদর আপ্যায়ন করতেন। মাঝে মাঝেই দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতেন। সেই বাড়িতে এতদিন পর এসেছি– আমাকে ভাত না খাইয়ে কি বিদায় দিতে পারে? বিদায় নিতে চাইলেও বিদায় নেয়া সম্ভব হলো না। বুঝতে পেলাম ক্ষুধা লাগুক আর না লাগুক ভাত খেয়েই যেতে হবে, এ ছাড়া উপায় নেই।

ছাত্রের মা মুরগী ধরার জন্য চেষ্টা করছেন। নিজেদের খোয়াড়ের মুরগী। মেহমান আসার অগ্রীম আভাস না থাকায় সকাল বেলা সব ছেড়ে দিয়েছেন। ছেড়ে দেয়া মুরগী ধরা কষ্ট, সেই দিক চিন্তা করেই ছাত্রের মাকে লক্ষ্য করে বললাম, ভাবি– মুরগী ধরা লাগবে না, মুরগীর মাংসে আমার রুচি নাই, ঢাকা শহরে প্রতি সপ্তাহেই মুরগী খাই, যেই খাবার ঢাকা শহরে পাওয়া যায় না সেই ধরনের খাবার খাওয়ান।
ছাত্রের মা চোখ কপালে তুলে বললেন, ঢাকা শহরে কি খাইতে পান না?
বললাম, টাটকা শাক-সব্জি পাই না, গাছ থেকে তুলে আনা টাটকা শাক-সব্জি রান্না করেন।
আমার বলার পরও অনেকক্ষণ মুরগী ধরার চেষ্টা করলেন কিন্তু ধরতে পারলেন না। মুরগী ধরতে না পেরে অবশেষে বাধ্য হয়েই আমার কথামত শাক সব্জিই রান্না করলেন।

খাওয়ার সময় ছাত্রের বাবাও আমার সাথে খেতে বসলেন। ছাত্রের মা বললেন, স্যার আপনার জন্যে দুগ্গা হাগড়া শাকের ছালুন রানছি। টাকি মাছ দিয়া রানছি, খায়া দ্যাহেন মজা পাইবেন।

জীবনে অনেক শাক খেয়েছি কিন্তু গ্রামের আগাছা এই হাগড়া শাক কোনদিন খাইনি। খুশি হয়েই বললাম, দেন।
আমার খুশি খুশি ভাব দেখে ছাত্রের মা পুরো দুই চামচ টাকি মাছের টুকরাসহ হাগড়া শাক আমার পাতে তুলে দিলেন। ভাতের সাথে হাগড়া শাক মিলিয়ে এক লোকমা মুখে দিতেই নাড়ি ভুড়ি উল্টে আসার অবস্থা। চোখ বন্ধ করে চিবিয়ে গিলে ফেললাম।

হাগড়া গাছকে আমি ছোট থেকেই চিনি। এটি একটি আগাছা। গ্রামের বাড়ির আশেপাশে বা খেত খামারে বন্যার পানি শুকিয়ে গেলে অযত্ন অবহেলায় এমনিতেই হয়। গাছটি বড় হলে কাঁটাযুক্ত ফল ধরে। এই ফলগুলো লম্বা মাথার চুলে পেঁচিয়ে দিলে প্যাচ খুলতে অনেক সময় খুব কষ্টই হয়। ছোট কালে বন্ধুদের লম্বা চুলে এই কাঁটাযুক্ত ফল ঘষে দিয়ে খুব মজা করতাম। কাঁটাযুক্ত ফল ছাড়াও এই গাছের কিছুটা বিদঘুটে গন্ধও আছে। সম্ভাবত গন্ধের কারণে গরু ছাগলেও এই গাছ খায় না। ভেবেছিলাম রান্নার পর হয়তো এর গন্ধ থাকে না। কিন্তু টাকি মাছ দিয়ে রান্নার পরও এর বিদঘুটে গন্ধ খুব একটা কমে নাই। যদি জানতাম রান্নার পরও এর গন্ধ অটুট থাকে তাহলে কি আর ছাত্রের মাকে খুশি হয়ে এই শাক দিতে বলি?

অর্ধেক শাক খাওয়ার পরে ছাত্রের মা আমাকে বলল, স্যার– হাগড়া ছালুন কেমুন হইছে?
মনে মনে ভাবলাম– যত বিদঘুটেই লাগুক না কেন, ছাত্রের মায়ের সামনে এই শাকের বদনাম করা যাবে না। যেহেতু আমার জন্য তিনি স্পেশাল রান্না করেছেন, বদনাম করলে মনে কষ্ট পাবেন এবং তার পরিশ্রমটাই বৃথা মনে করবেন। তাই তাকে খুশি করার জন্য অন্তরের কথা অন্তরে চাপা রেখে মুখে খুশি খুশি ভাব এনে প্রশংসার সুরেই বললাম, খুব ভালো হয়েছে।

খুব ভালো হয়েছে কথাটি বলতে না বলতেই আরো দুই চামচ পাতে তুলে দিলেন। আমি এখন খাবো না কাঁদবো ভেবে পাচ্ছি না। যেটুকু খেয়েছি তাতেই আমার বমি আসার অবস্থা তারোপর আরো দুই চামচ, বেক্কেলের মত কেন যে প্রশংসা করতে গেলাম সেইটা ভেবে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম।

এরপর চোখ বুঁজে অনুরোধে নয় অতি আদরে ঢেঁকি গেলার মত গিলতে লাগলাম। বহু কষ্টে ভাত খাওয়া শেষ করে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। পেটের ভিতর মোচর দিয়ে উঠল, গলা দিয়ে বমি ঠেলে আসতে লাগল। দৌড়ে বাড়ির দক্ষিণ পাশে তাল গাছের নিচে দাঁড়াতেই ওয়াক্ ওয়াক্ করে পুরো বমি করে দিলাম। ছাত্রের বাবা মা দৌড়ে এলেন, কি হলো — কি হলো- – ?
আমি নিজেকে সামাল দিয়ে বললাম, কিছু না। রৌদ্রের মধ্যে হেঁটে এসেছি তো এইজন্য পেটে মোচর দিয়েছে।
আমি যত খুশিভাব নিয়েই বলি না কেন তাদের মুখটা কালো হয়ে গেলো। আমাকে স্পেশাল রান্না করা খাবার খাইয়ে খুশি করতে গিয়ে তারা যেন উল্টো বিপদেই পড়েছেন।

আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে বিদায় নিলাম। বিদায় নেয়ার সময় ছাত্রের মা বিষন্ন বদনে ঘরের বারান্দা থেকেই বিদায় দিলেন, বাড়ির বাইরে এলেন না, কিন্তু ছাত্রের বাবা রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন।

ঢাকায় ফেরার সময় বার বার ছাত্রের মায়ের বিষন্ন বদনের ছবি চোখে ভাসতে লাগল। আহা! বেচারী আমাকে ভালো কিছু খাইয়ে খুশি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু হাগড়া শাক খাওয়ার অনাভ্যাসের কারণে পেটে সহ্য হলো না। মনে মনে নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিতে লাগলাম, কেন যে বমি করতে গেলাম, বমিটা একটু কন্ট্রোল করতে পারলেই তো এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

০০০ সমাপ্ত ০০০
(ছবি ইন্টারনেট)

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *