রম্য ঃ ট্রেনের কামরায় রহস্যময় ব্যাগ

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাত দুইটার দিকে বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়েছে। গভীর রাত হওয়ায় ট্রেনের দুলুনিতে চোখে ঘুমের ভাব চলে আসে। সিটে বসা অবস্থায় কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম বলতে পারবো না। হঠাৎ ঝাকুনি খেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ট্রেন জামালপুর স্টেশনে এসে থেমেছে। জামালপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পূর্ব মুহুর্তে দু’জন রেলওয়ে পুলিশ আমাদের কামরায় উঠল। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই তারা যাত্রীর ব্যাগ তল্লাশী করে অবৈধ জিনিষ পত্র খুঁজতে লাগল। কারো ব্যাগেই কিছু পেল না। আমার সামনের সিটের যাত্রী স্যুট কোট পরা বিশিষ্ট ভদ্রলোক। মনে হয় কোন অফিসের কর্মকর্তা হবেন। তিনি একটা বড় ধরণের দামি ব্যাগ সিটের নিচে ঢুকিয়ে বসে আছেন। পুলিশ সবশেষে সিটের নিচ থেকে সেই ব্যাগটি টেনে বের করল। ব্যাগটি কার? জিজ্ঞেস করতেই সিটে বসে থাকা ভদ্রলোক বলল, ব্যাগ আমার।
— ব্যাগের ভিতর কি আছে?
— খারাপ কিছু নাই, তবে ব্যাগ খোলা যাবে না।
— কেন?
— সমস্যা আছে
— কি সমস্যা?
— সমস্যাটা বলতে পারছি না, যে কারণে খুলতেও পারছি না।
ভদ্রলোকের এমন কথায় পুলিশের ব্যাগ তল্লাশির আগ্রহ বেড়ে গেল। ব্যাগে ছোট একটি তালা ঝুলানো আছে। পুলিশ ব্যাগের তালা খোলার জন্য ভদ্রলোককে নির্দেশ দিলেও ভদ্রলোক কোন মতেই ব্যাগের তালা খুলতে রাজি হচ্ছেন না। অবশেষে পুলিশ ব্যাগ তল্লাশী করতে না পেরে ময়মনসিংহ স্টেশনে গাড়ি থামার সাথে সাথে একজন পাহারায় থেকে অন্যজন নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর রেলওয়ে পুলিশের হাবিলদারসহ আরো তিনজন পুলিশ এসে হাজির হলো। মোট পাঁচজন পুলিশ দেখে ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে গেল। ব্যাগের ভিতর কি আছে সেটা দেখার জন্য আমাদেরও আগ্রহ বেড়ে গেল। কিন্তু আমাদের আগ্রহ থাকলেও আমরা কেউ পুলিশের সামনে কোন কথা বললাম না।
স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ানো অবস্থায় হাবিলদার কিছুই বলল না। গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর পরই কামরার দুই দরজায় তিনজন পুলিশকে পাহারা দিতে বলে হাবিলদার একজন কনস্টেবল সাথে নিয়ে ভদ্রলোকের কাছে এসে বলল, আপনার ব্যাগটা খোলেন।
— ভাই ব্যাগটা না খুললে হয় না?
— কেন, ব্যাগে কি আছে? সবাই ব্যাগ খুলে দেখালো আপনি দেখাবেন না কেন?
ভদ্রলোক মুখটা কাচুমাচু করে বলল, ভাই ব্যাগটায় সমস্যা আছে।
হাবিলদার রাগত স্বরে বলল, এই সব সমস্যা দেখার জন্যই সরকার আমাদের নিয়োগ দিয়েছে। আপনি যদি স্বেচ্ছায় ব্যাগ না খোলেন তবে বাধ্য হবো ব্যাগসহ আপনাকে থানায় নিয়ে যেতে। আমি এই লাইনে দীর্ঘদিন হলো আছি। প্রতি মাসেই অবৈধ জিনিষপত্রসহ স্ম্যাগলিং অনেক কিছু ধরে থাকি। কাজেই আপনাকে আমরা সহজেই ছাড়ছি না। আপনার ব্যাগে যদি অবৈধ কিছু না থাকে তবে এতো পীড়াপীড়ি করা সত্বেও আপনি ব্যাগ খুলছেন না কেন? আমাদের আর বুঝতে বাকি নাই আপনার ব্যাগে কি আছে। আমাদের সহজ কথায় যখন আপনি ব্যাগ খুলছেন না তখন পুলিশী নিয়মেই আপনার ব্যাগ তল্লাশী করতে বাধ্য হবো। এ কথা বলেই হাবিলদার কনস্ট্যাবলদের আদেশ দিলেন, এই আপনারা সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন।
কনস্টেবলরা সাথে সাথে কামরার দরজা-জানালা বন্ধ করে দিল। হাবিলদার মেজাজ গরম করে ধমক দিয়ে বলল, এবার ব্যাগ খোলেন, নইলে অসুবিধায় পড়বেন।
হবিলদারের গরম মেজাজ হুমকি-ধমকি আর থানার কথা বলায় ভদ্রলোক কিছুটা ভরকে গিয়ে অনিচ্ছা সত্বেও পকেট থেকে চাবি বের করে হাবিলদারের হাতে দিলেন। হাবিলদার চাবি নিয়ে বলল, এবার আপনি ব্যাগটা খোলেন।
ভদ্রলোক ব্যাগ না খুলে উল্টো হাবিলদারকে বললেন, আপনার যখন দেখার এতো আগ্রহ তখন আপনিই খোলেন। আমার পক্ষ থেকে কোন আপত্তি নাই।
হাবিলদার চাবি দিয়ে তালা খুলে চেইন টান দিয়ে ব্যাগের মুখ হা করাতেই ব্যাগের ভিতর আরেকটি কাপরের ব্যাগ চোখে পড়ল। ভিতরের ব্যাগটির মুখ রসি দিয়ে ভালো করে বাঁধা।
হাবিলদার ব্যাগের ভিতরে আরেকটি ব্যাগ দেখে অবৈধ জিনিষপত্র আছে মনে করে খুব আগ্রহী হলেন। মনে মনে ভাবলেন, এবার হয়তো একজন ক্যুখ্যাত স্মাগলার পাওয়া গেছে। একে ধরিয়ে দিতে পারলে উপরওয়ালার কাছে সুনাম পাওয়া যাবে। পুলিশী কায়দায় ধমকের সুরে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলেন, ভিতরের ব্যাগে কি আছে?
ভদ্রলোক এবারও সহজ ভাবেই বললেন, আপনি নিজ হাতে খুলে চেক করে দেখেন কি আছে?
হাবিলদার তাড়াতাড়ি খুব আগ্রহ নিয়ে ব্যাগের মুখ খুলে ভিতরে হাত দিয়ে মুখটা মলিন করে বললেন, এগুলো কি নিয়েছেন?
ভদ্রলোক কিছুটা শ্লেষমিশ্রিত কণ্ঠেই বললেন, আপনি তো নিজেই হাত দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন, আমাকে আর মুখে বলতে বলছেন কেন?
হাবিলদার রাগত স্বরে বললেন, এটা আমাদের আগে বললেই তো হতো।
— আপনি যে ভাবে ভয়ভীতি দেখালেন তাতে তো বলার সুযোগই পেলাম না।
— এগুলো কেন নিয়েছেন?
— আমার ছোট বোন ঢাকায় নতুন বাসা নিয়েছে, সে মায়ের কাছে চিঠি লিখেছে ঢাকা শহরে সব পাওয়া যায় শুধু এটাই নাকি খুব অভাব। তাই অন্য কিছু বাদ দিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে এগুলো নিতে বলেছে। তাই নিয়ে যাচ্ছি।
এবার হাবিলদার মুখটা কালো করে ব্যাগের ভিতরেই হাত পরিস্কার করতে লাগলেন। হাবিলদারের এ অবস্থা দেখে আমি একটু আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই ব্যাগের ভিতর কি জিনিষ?
হাবিলদার বিরক্ত ভাবেই জবাব দিল, অবৈধ কিছু নয়, তবে বলা যাবে না। বলেই সে ব্যাগ থেকে হাত বের করে লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বিরক্ত প্রকাশ সহ যে পুলিশটা ডেকে এনেছিল তাকে বকাবকি করতে করতে দরজার দিকে চলে গেল। তার হাতের দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম কালো কালো পাউডারের মত কি যেন পাঁচ আঙুলে লেগে আছে।
একটু পরেই গাড়ি গফরগাঁও স্টেশনে থামলে সব পুলিশ নেমে গেল।
কামরার যাত্রীরা পুলিশ এবং ভদ্রলোকের এসব ঘটনা আগ্রহসহ দেখতে ছিল। কেউ কোন কথা বলার সাহস পেল না। পুরো কামরা নিরব নিস্তব্ধ হয়ে আছে। আমি নিরবতা ভঙ্গ করে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, মনে কিছু করবেন না, সত্যি করে বলেন তো, ব্যাগের ভিতর কি এনেছেন?
আমার এমন প্রশ্নে ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, আরে ভাই আপনিও তো দেখি পুলিশের মত পাগোল হয়ে গেলেন। কি নিয়েছি পুলিশ যখন বলল না তখন আপনার শোনার এতো আগ্রহ কেন? বলেই ব্যাগের উপর খুলে রাখা রসি হাতে নিয়ে ভিতরের ব্যাগের মুখ দুই হাতে চেপে ধরতেই ভক্ করে কিছু ছাই উড়ে এসে আমার এবং আমার পাশের যাত্রীর চোখে মুখে ঢুকে গেলো।
চোখ কচলাতে কচলাতে বললাম, আরে ভাই করেন কি, ছাই উড়াচ্ছেন কেন?
ভদ্রলোক মুখটা বাঁকা করে বলল, আরে ভাই ব্যাগের ভিতর আছে ছাই, ছাই উড়াবো না তো টেলকম পাউডার উড়াবো?
আমি ভদ্রলোকের কথা শুনে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই মনে যদি কিছু না করে তবে আরেকটি কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
— করেন।
— এতো সুন্দর ব্যাগের মধ্যে ছাই ঢুকালেন কি করতে?
ভদ্রলোক ব্যাগের মুখ বাঁধতে বাঁধতে বিরক্ত ভাবে বললেন, আরে ভাই বললাম তো, ছোট বোনটা চিঠি লিখেছে ঢাকা শহরে সব পাওয়া যায় কিন্তু থালা বাসন মাজার জন্য নাকি ছাই পাওয়া যায় না, তাই সব বাদ দিয়ে ব্যাগ ভর্তি ছাই নিতে বলেছে। সেই জন্য ব্যাগ ভর্তি ছাই নিয়েছি। শালার পুলিশ এইটা দেখার জন্য পাগোল হয়ে গেলো। দেখে তো নিজেও আহম্মক হলো আমাকেও আহাম্মক বানালো।
ভদ্রলোকের কথা শুনে কামরার সব যাত্রী হো হো করে হেসে উঠল। তার কথা শুনে যাত্রীরা হো হো করে হেসে উঠায় ভদ্রলোক লজ্জায় মাথা নিচু করলেন। ঢাকা স্টেশনে পৌছার পূর্ব মহূর্ত পর্যন্ত তিনি কারো সাথে আর কোনো কথাই বললেন না।

-ঃ সমাপ্ত ঃ-

ছবি ঃ গুগল

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *