দুধ লাল

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

এসএসসি পাশ করে জেলা শহরে এসে কলেজে ভর্তি হয়েছি। ভর্তি হওয়ার পর প্রথম ক্লাস। দশটায় ক্লাস শুরু। বন্ধুদের সাথে আমিও শিক্ষক আসার আগেই ক্লাসে ঢুকে বেঞ্চ দখল করে বসে আছি। আমার ডান পাশে স্কুলজীবনের দুই সহপাঠী, বাম পাশে মাঝারী চেহারের একজন অপরিচিত ছাত্র।

কলেজ জীবনের প্রথম ক্লাস। অতি আগ্রহ নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষণ পরেই বাংলা স্যার হাজিরা খাতাসহ ক্লাসে ঢুকলেন। গ্রাম্য স্কুলের স্বভাব অনুযায়ী বেশিরভাগ ছাত্রই উঠে দাঁড়ালাম। স্যার আমাদের হাত ইশারায় বসতে বললেন। সবাই স্যারের ইশারায় বসে গেলাম। স্যার তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে বললেন, আজ তোমাদের কলেজ জীবনের প্রথম ক্লাস। রোল নাম্বারের পাশাপাশি নাম ধরে ডাকব। পরবর্তী ক্লাস থেকে আর কখনও নাম ধরে রোল কল করা হবে না। তোমরা তোমাদের নামের পাশে রোল নাম্বার মনে রাখবে।

স্যার রোল নাম্বারের পাশাপাশি সবার নাম ধরে ধরে রোল কল করা শুরু করলেন। প্রায় তিন শ’ ছাত্র। কলেজ জীবনের প্রথম ক্লাস হওয়ায় ক্লাসে ছাত্রের উপস্থিতি অনেক। বেঞ্চে জায়গা হচ্ছে না। পিছনে কিছু ছাত্র দাঁড়িয়ে আছে। এক শ’ সিরিয়ালের পরে আমাদের তিন বন্ধুর রোল এবং নাম কল করলে ইয়েস স্যার বলে জবাব দিয়ে বসে পড়ি। আরো কয়েক জন ছাত্রের নাম ডাকার পরে স্যার রোল নাম্বার বলার পরে ‘দুধ লাল, দুধ লাল’ বলেই থেমে গেলেন। আমি স্যারের মুখে ‘দুধ লাল’ শুনে হাসি চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে উঠলাম। স্যার তৎক্ষনাত বলে উঠলেন, কে কে, হেসে উঠল কে? আমি সাত আটটি বেঞ্চ পরেই বসা ছিলাম। আমার দিকে আঙ্গুল ইশারা করে বললেন, এই ছেলে দাঁড়াও। ক্লাসে অনেক ছাত্র থাকায় আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কাকে দাঁড়াতে বলছেন। আমি স্যারের দিকে তাকেতেই স্যার আঙুল তুলে বললেন, ইউ, ইউ। আমি বুকে হাত দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে বললাম আমি কিনা। স্যার বললেন, ইয়েস, ইউ। আমি কিছু না বুঝেই অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে গেলাম। স্যার কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন, এই ছেলে, তুমি হাসলে কেন?

কলেজের প্রথম ক্লাস হওয়ায় আমার মধ্যে কিছুটা জড়তা কাজ করছিল। জড়তার মাঝেও সাহস নিয়ে বললাম, স্যার, সারা জীবন দেখে এসেছি দুধ সাদা, আজই প্রথম শুনলাম দুধ লাল।
একথা বলার সাথে সাথে পুরো ক্লাস জুড়ে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পুরো ক্লাসে হাসি দেখে স্যার জোরে শব্দ করে বলে উঠলেন, প্লিজ সাইলেন্ট।

সবাই থেমে গেলে স্যার বললেন, কারো নাম নিয়ে হাসাহাসি করা ঠিক নয়। সবাইর নাম তো এক হতে পারে না। বিভিন্ন নামের মাঝে দু’একটি আনকমন নাম থাকতেই পারে? তাই বলে কি তোমরা হাসাহাসি করবে? সবার যদি একই নাম হয়, তহলে কে কাকে ডাকল, কি করে বুঝবে? কাজেই আনকমন নাম নিয়ে কেউ হাসবে না। বলেই স্যার বললেন, দুধ লাল কে? দুধ লাল যে আমার পাশেই বসা ছিল আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে বলল, জি স্যার, আমার নাম দুধ লাল।

দুধ লাল দাঁড়ানোর সাথে সাথে পুরো ক্লাসের ছাত্ররা তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। স্যারও তাকে এক নজর দেখেই বললেন, ঠিক আছে বস। বলেই স্যার আবার রোল কল করতে লাগলেন।

দুধ লাল বেঞ্চে বসে নিচের দিকে মাথা নত করে থাকল। স্যার রোল কল করে অল্প সময় প্রথম ক্লাস হিসাবে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু বক্তৃতা দিয়ে চলে গেলেন।

স্যার চলে গেলে বেশিরভাগ ছাত্রই বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ক্লাসে স্যার না থাকায় কেউ কেউ বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে আবার কেউ কেউ বেঞ্চে বসে পরস্পর গল্প করছে । কিন্তু তখনও দেখি দুধ লাল নিচের দিকে মাথা দিয়ে বসে আছে। আমি সহপাঠি হিসাবে তাকে লক্ষ্য করে বললাম, কিরে, তোর নাম যে দুধ লাল, আগে বলবি না? আমি স্যারের কাছে তোর নাম নিয়ে ইয়ার্কী করলাম।
দুধ লাল মাথা তুলে বলল, তাতে কি হয়েছে? তুই তো আর আমার নাম জানিস না। জানলে তো আর ইয়ার্কী করতিস না।

এর পরে লক্ষ্য করেছি ক্লাসে আসলেই ও আমার কাছে বসতো। আমার পাশে সিট না থাকলে একবারে পিছনে চলে যেত। শহরের কোন ছেলের কাছে বসতো না। আমার পাশে বসে ক্লাস করায় ওর সাথে আমার মোটামুটি ভাল সখ্যতা হয়েছে। সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর অনেক দিন ওর সাথে দেখা হয় না।

একদিন কলেজ থেকে ফিরে শহরে ঢুকতেই আমার পায়ের চপ্পলের ফিতা ছিঁড়ে গেল। রেল গেট পার হয়েই দেখি একজন তরুণ মুুচী মাথা নিচু করে জুতা সেলাই করছে। আমি পা থেকে চপ্পল খুলে তার সামনে দিয়ে বললাম, এই, আমার চপ্পলের ফিতেটা সেলাই করে দেতো।

তরুণ মুচী মাথা না তুলেই আমার চপ্পল সেলাই করে সামনে ঠেলে দিয়ে অন্য একটি জুতা সেলাই করতে লাগল। মাথা না তুলে জুতা সেলাই করাটা আমার কাছে খুব অহঙ্কারী মনে হলো। আমি তার অহঙ্কারকে তুচ্ছ করার জন্য তুচ্ছ ভাবেই বললাম, সেলাই কত রে?
তরুণ মুচী মাথা না তুলেই জবাব দিল, পয়সা লাগবে না।

আমার কাছে তার কথাটা আশ্চার্য মনে হলো। চেনা নাই জানা নাই মুচী পয়সা নিবে না। এ আবার কেমন কথা! আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কেন রে, পয়সা লাগবে না কেন?

— ইচ্ছা হলো না তাই পয়সা নেব না।
— কাজ করেছিস পয়সা নিবি না মানে?
— আমার ইচ্ছা আমি নেব না।
— নিবি না কেন, নিতেই হবে, বলেই আমি দু’টাকা তার সামনে ফেলে দিলাম।
সে টাকা হাতে নিয়ে আমার পায়ের কাছে ছুড়ে দিল।
মুচীর ব্যাবহারটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগল। একে তো মুচী তারোপর মুখ না তুলেই অহঙ্কার করে কথা বলছে। জুতা সেলাইয়ের টাকা দিলাম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে আমার পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিল। হাজার হলেও মুচী হলো নীচু জাত, ওর কাছে দু’টাকার জন্য ছোট হওয়াটা বিবেকে লাগল। মনে করলাম হয়তো টাকা কম হয়েছে এইজন্য ও টাকা ছুড়ে মেরেছে। আমি আরো দু’টি টাকা ওর সামনে দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। ও তৎক্ষনাৎ টাকাটা সামনে ছুড়ে দিয়ে বলল, বললাম তো টাকা নিব না।
তরুণ মুচীর দেমাগ মার্কা কথায় মেজাজ বিগড়ে গেল। চোখটা বড় করে ধমকের সুরে বললাম, নিবি না কেন? টাকা তুলে রাখ, না হলে লাথি দিয়ে মাথা চ্যাপ্টা করে দিব।
— লাথি দিলে দে তারপরেও তোর টাকা নিব না।
মুচীর মুখে তুই তোকারী কথা শুনে আরো অপমানবোধ করলাম। মনে মনে ভাবলাম, এই মুচী তো দেখচি আচ্ছা ঠ্যাটা। অনেক বয়স্ক মুচীকে দেখেছি বাবুজি ছাড়া কথা বলে না আর অল্প বয়স্ক এই মুচী আমাকে তুই তোকারী করে কথা বলে। মুচী যাতে আর কোনদিন আমাকে তুই করে কথা বলার সাহস না পায় সেই রকম একটা ভাব নিয়ে রাগত স্বরে বললাম, তুই আমাকে তুচ্ছভাবে কথা বললি কেন রে?
— আমি তোর বন্ধু এই জন্য তুচ্ছভাবে কথা বললাম।
— আমি তোর কবে বন্ধু হলাম রে?
— অনেক আগে।
— দেখি তোর মুখটা?
— মুখ দেখাবো না, তুই চলে যা।
ওর কথায় আমার কেমন সন্দেহ হলো। আমার কোন মুচী বন্ধু নেই, এটা কোথাকার মুচী আমাকে বন্ধু দাবী করছে। তার মুখ দেখার জন্য আরো গো ধরে বললাম, আমি তোর মুখ না দেখে যাবো না। বলেই ওর চুল ধরে উপর দিকে মুখটা তুলতেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ যে দুধ লাল! দুধ লাল যে মুচী এটা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। মনের অজান্তেই দুটি কথা বেরিয়ে গেল, দুধ লাল– তুই কি মুচী রে?
ও মাথা নেরে বলল, হ্যাঁ।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভেজা ভেজা চোখে বলল, তুই কি এখন আমাকে ঘৃণা করবি রে?
একে তো ক্লাস ফ্রেন্ড তারোপর চোখের জল ছেড়ে দেয়ায় মায়া হলো। মুহুর্তেই ঘৃণার কথা ভুলে গেলাম। সহজ সরল ভাবে দুধ লালের চোখর দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে বললাম, না রে, তুই আমার বন্ধু, তোকে কি আমি ঘৃণা করতে পারি?
ও আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল, সত্যিই বলছিস? তুই আমাকে ঘৃণা করবি না তো?
আমি মাথা নাড়ালাম, না।
আমার কথা শুনে ওর মলিন মুখটি মুহুর্তেই উজ্জল হয়ে উঠল। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, তোর প্রতি আমি খুব খুশি হলাম রে। স্কুল জীবনের অনেক বন্ধুই কলেজে পড়ে। কিন্তু মুচী হওয়ার কারণে তারা কেউ আমাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে না। স্কুলেও আমাকে কাছে ঘেষতে দিত না, কলেজে এসেও কাছে ঘেষতে দেয় না। পরিচয় না জানার করণে কলেজে একমাত্র তুই আমাকে কাছে বসতে দিয়েছিস। কাজেই তোকে আমি বন্ধু হিসাবে পেয়ে খুব খুশি রে। তুই যখন আমাকে জুতা সেলাই করতে দিয়েছিস, তখন আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছিলাম না। তাই নিচের দিকে মুখ করে বসে ছিলাম। তুই চুল ধরে মাথা না উঠালে আমি কখনই মুখ তুলতাম না।

এতক্ষণে ওর মাথা নিচু করে বসে থাকার কারণ বুঝতে পারলাম। আমি তখন প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গ নেয়ার চেষ্টা করে বললাম, তুই কলেজে যাস না কেন?
দুধ লাল অসহায়ভাবে বলল, আমার বাবা খুব অসুস্থ্য রে। যে কারণে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে আমাকে কাজ করতে হ্েচছ।
— তোর বাবা সুস্থ্য হলেই কলেজে আসিস। বলেই আমি ওর কাছ থেকে দ্রুত সরে গেলাম। ওর সামনে থেকে দ্রুত সরে গেলে কি হবে, ওকে লাথি মারতে চাওয়াটা আমার কাছে খুব অপরাধবোধ মনে হলো। নিজের বিবেকের কাছে নিজেই হেয় হতে লাগলাম।

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *