পাথর ভাগ্য (রম্য)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
সকালে গুলিস্থান রাজধানী হোটেলে নাস্তা খেতে গিয়েছি। আমি যে টেবিলে বসেছি তার সামনের টেবিলে দুইজন লোক বসেছে। একজনের হাতের দিকে তাকাতেই আমার চোখ থেমে গেল। তার বাম হাতের পাঁচ আঙুলে সাতটি আঙটি। বৃদ্ধাঙ্গুলি বাদ দিয়ে বাকি চার আঙুলেই পাথর বসানো আঙটি। কনিষ্ঠ আঙুলে একটি, অনামিকায় একটি, মধ্যমা আঙুলে তিনটি, তর্জনীতে দু’টি। ডান হাতও খালি নেই। ডান হাতের মোগরায় লোহার বয়লা। মাথার চুল কিছুটা লম্বা লম্বা। মেরুণ রঙের প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট পরেছে। বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশের কম নয়।
তার হাতে এত রঙ বেরঙের পাথরের আঙটি দেখে কৌতুহল জাগল। আমি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসলাম। একথায় সেকথায় খাতির জমিয়ে আস্তে আস্তে তার আঙটির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আপনার হাতে যে এত আঙটি দেখতেছি, এগুলো কি পাথরের আঙটি?
লোকটি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসি দিয়ে বলল, জী ভাই, সবটি পাত্থর।
— আপনি পাথর কি নিজে নিজে কিনেছেন না জ্যেতিষীদের পরামর্শে কিনেছেন?
আমার কথা শুনে বিজ্ঞের মত বলল, নিজে নিজে পাত্থর কিনলে কি কাজ হইবো, যারা পাত্থর চেনে তাদের পরামর্শে কিনলে না কাজ হইবো। আমি তিনটা জ্যোতিষীরে হাত দেখাইয়া তারপরে আঙটি কিনছি।
— আপনি কি কি পাথর কিনেছেন?
ডান হাতের আঙুল দিয়ে বাম হাতের আঙুলের আঙটিগুলি একটি একটি করে দেখিয়ে পাথরের নাম বলতে লাগল, এইটা হলো সোলাইমানী আকীক, এইটা নীলা, এইটা গোমেদ, এইটা মুন, আরো কি কি পাথরের নাম বলল আমার সে সব মনে নেই। তবে বুঝলাম সে অনেক পাথরের নাম জানে।
জিজ্ঞেস করলাম, এই সব পাথরে কি কি কাজ হয়?
— কি কি কাজ হয় কেমনে বুঝাই আপনারে, তয় অনেক কাজ হয়।
— আপনার হাতের পাথরও কি অনেক কাজ করে?
লোকটি খুব দৃঢ়তার সাথে বলল, অবশ্যই করে, করবো না ক্যান? এইগুলা কি প্লাস্টিকের পাত্থর নাকি। এইগুলা অরজিনাল আল্লার সৃষ্টি পাত্থর।
— আলাদা আলাদা পাথরে কি আলাদা আলাদা কাজ করে?
আমার কথায় আমাকে অনাভিজ্ঞ মনে করে বলল, আপনি দেখি পাত্থর সম্বন্ধে কোন জ্ঞানই রাখেন না। সব পাত্থর একই কাজ করলে কি আর এত পাত্থর হাতে লই। একটা নিলেই তো হইতো?
— কোন পাথরে কি কাজ করে, একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
আমার এমন প্রশ্নে কিছুটা বিরুক্ত হয়েই বলল, কোন পাত্থরে কি কাজ করে এত কইবার পারুম না। তয় শনির দৃষ্টি কাইটা যাওয়ায় অনেক বিপদ-আপদ থাইকা রক্ষা পাইছি। আয় রোজগারও বাইড়া গেছে। আল্লায় দিলে খুব ভাল আছি, খুব সুখে আছি। বলেই লোকটি উঠে চলে গেল। আমি তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
পাথরের উপরে তার আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হলাম। তার কথা শুনে মনের মাঝে কিছু প্রশ্নও দেখা দিল– তার কি কি বিপদ ছিল আর কি কি বিপদ কেটে গেছে সে কি করে বুঝলো? পাথর সম্পর্কে তার এমন বিশ্বাসের কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না।
এর কয়েকদিন পরের ঘটনা ঃ পায়ে হেঁটে গুলিস্থান সিনেমা হলের সামনে দিয়ে ঠাঁঠারী বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। গুলিস্থান মোড় পার হয়ে দক্ষিণ দিকে কিছুদূর যেতেই রাস্তার পাশে হকারের আকর্ষণীয় চেচামেচি কানে এলো। তাকাতেই দেখি সেই আঙটিওয়ালা লোকটি হকারী করছে। পীচঢালা রাস্তার উপর পলিথিন বিছিয়ে তার উপর কিছু পাঞ্জবী সাজিয়ে রেখে সাথে আরো দুইজন অল্প বয়সী ছোকরা নিয়ে সুর করে কোরাস গাইছে, বাইচ্ছা লন– তিন শ’, দেইকখা লন– তিন শ’, গুইন্না লন– তিন শ’, সস্তায় লন– তিন শ’,।
তার হকারী সুরের সাথে ছোকরাদের তাল মেলানো শরীর দোলানো দৃশ্য দেখে মনে হলো– হাতের আঙটি বা পাথর তাকে ভালই সুখে রেখেছে। এরকম সুরে বেসুরে চিল্লানো কথাগুলো দুই একজন নয় হাজার হাজার মানুষকে শোনাতে পারছে, বিনিময়ে রোজগারও হচ্ছে, এটাও কম সুখের নয়।
আমি দূরে দাঁড়িয়ে তার হকারী কার্যকলাপগুলো দেখতেছিলাম। হঠাৎ কয়েক জন পুলিশ রাস্তার হকারদের তাড়াতে লাগল। একজন পুলিশ পাথরওয়ালার পাছায় ঠাস্ করে বাড়ি দিতেই পাছা ডলতে ডলতে দৌড়ে পালিয়ে গেল। ছোকরা দুইজন দ্রুত পলিথিনের দুই মাথা ধরে পঞ্জাবীগুলো নিয়ে পাশের হকার মার্কেটে ঢুকে মূহুর্তেই গায়েব হয়ে গেল।
পাথরওয়ালার পাছায় পেটন আর পাছা ডলতে ডলতে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে হাসি আটকাতে পারলাম না। হাসির মাঝেও মনে হলো– বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার মত অনেক পাথর আঙুলে থাকলেও পুলিশের পেটন থেকে রক্ষা পাওয়ার মত একটি পাথরও হয়তো তার আঙুলে নেই, যদি থাকতো তাহলে কি আর পুলিশ তাকে পেটন দিতে পারতো? মোটেই পারতো না। আমার মনে হয় তাকে আবারও জ্যোতিষীর কাছে যাওয়া দরকার, পুলিশ পেটনের শনির দশা থেকে রক্ষা পেতে আরো পাথর ধারন করা দরকার।
ছবি ঃ ইন্টারনেট
Recent Comments