আমার মামা এবং একাত্তুরের যুদ্ধ

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আমার মেজ মামা। নাম আবু তাহের প্রধান। একাত্তর সালে যুদ্ধের সময় তিনি কিশোর গঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মিঠামইন থানায় (বর্তমানে উপজেলা) কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক কয়েক দিন আগে হুট করে মামা আমাদের বাড়ি এসে হাজির। দু’দিন থাকার পরই কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থতি তখন খুবই নাজুক। এমতোবস্থায় বাবা মামাকে চাকরিতে যেতে নিষেধ করলেন, কিন্তু মামা বাবার নিষেধ মানলেন না, জোর করেই কর্মস্থলে চলে গেলেন।

মামা চলে যাওয়ার পর থেকে যুদ্ধের পুরো নয় মাস তার আর কোন খোঁজখবর ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পনরো দিন পরেই হুট করে মামা এসে হাজির। সবাই তো অবাক! মা তো মামাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললেন। আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম এই যুদ্ধে মামা হয়তো বেঁচে নেই। সেই মামা হুট করে কোথা থেকে বের হলো, এতদিন কোথায় ছিল? আমাদের এই প্রশ্নের উত্তরে মামা যা বললেন তা হলো– মামা কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার মিঠামইন অফিসে পৌঁছার পর দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। সারা দেশে পাক সেনাদের হত্যা যজ্ঞ শুরু হলে মিঠামইনও এই হত্যা যজ্ঞের বাইরে ছিল না, পাক সেনাদের হত্যা যজ্ঞের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে চাকরি ছেড়ে তারই এক সহকর্মীর সাথে গফর গাঁও চলে আসেন। কয়েক দিন সেই সহকর্মীর বাড়িতে অবস্থান করার পর বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেও পারছিলেন না। মামার বাড়ি ছিল তখন রংপুর জেলার নীলফামারি মহকুমার (বর্তমানে জেলা) ডিমলা থানায় (বর্তমানে উপজেলা)। যুদ্ধের মধ্যে ময়মনসিংহের গফর গাঁও থেকে উত্তর বঙ্গের নীলফামারি যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। আমাদের বাড়িও ছিল রংপুর জেলার অন্তর্গত গাইবান্ধা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) ফুলছড়ি থানায় (বর্তমানে উপজেলা)। আমাদের এখানে আসাও সম্ভব ছিল না। কারণ, কয়েকশ’ মাইলের পথ পায়ে হেঁটে আসলেও মাঝখানে বিশাল যমুনা নদী পার হওয়া আরও বিপজ্জনক ছিল। যমুনা নদীর দুই পারে দু’টি রেলের ফেরি ঘাট। পশ্চিম পারে ফুলছড়ি ঘাট ( পরে নাম পরিবর্তন করে তিস্তমুখ ঘাট বর্তমানে বালাসী ঘাট) এবং পূর্ব পারে বাহাদুরাবাদ ঘাট। এই দু’টি ঘাটেই ছিল পাক সেনাদের শক্ত ঘাঁটি। খান সেনাদের কড়া পাহাড়ার নজর এরিয়ে এপার ওপার দশ মাইলের বিশাল নদী পার হওয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। নদীতে নৌকা দেখলেই খান সেনারা গুলি করতো।

এমতোবস্থায় মামাকে অফিস কলিগ হিসাবে তিনি তার নিজের বাড়িতে কিছুদিন রাখলেও দেশের যুদ্ধবস্থা এবং পারিপার্শ্বিক কারণে বেশিদিন রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। মামাকে বাড়ি থেকে বিদায়ও করতে পারছিলেন না। মামার অসহায়ত্ব এবং দেশের পরিস্থিতির কারনেই তিনি তার পাশের বাড়িতে আশ্রয়ের ব্যাবস্থা করে দেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো যার বাড়িতে তিনি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দীন-এর আপন চাচা।

ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দীন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে অনেক কঠিন সাজাভোগ করেছিলেন। আর্মি হওয়ায় পাকিস্তান আর্মিরা ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দীনকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসাবে আর্মিদের যত কঠিন শাস্তি আছে সবই তাকে ভোগ করতে হয়েছিল, এমন কি তাঁকে হাত পা বেঁধে পাকা ফ্লোরের উপরে চিৎকরে শোয়ায়ে পুরো শরীর বুট জুতা দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পারিয়ে পারিয়ে আধমরা করে ছেড়েছিল কিন্তু এত কঠিন শাস্তির পরও তাঁর মুখ থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোন কথা বলাতে পারে নাই। দেশের জন্য যারা আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসাবে এমন কঠিন শাস্তি ভোগ করেছেন তাদের এই অবদান কোনভাবেই ভোলার মত নয়।

আমার মামা বিপদে পরেই যুদ্ধের পুরো নয় মাস ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দীন-এর চাচার বাড়িতে অবস্থান করে ছিলেন। চাকরি জীবনের শেষ সময়ে মামা লালমনির হাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ২০০২ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *