মধুপুর হোটেলের মাংসের স্বাদ

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

কুষ্টিয়া মধুপুর হোটেলের মাংসের সুস্বাদের কথা আগেই শুনেছিলাম। সেই সূত্র ধরেই কুষ্টিয়া থেকে ২২কিলোমিটার দূরে মধুপুর রওনা হলাম। প্রথমেই গেলাম মজমপুর গেট থেকে স্কুটারে চরে চৌরহাস। সেখান থেকে ইসলামিক ইউনিভার্সিটিগামী আরেকটি স্কুটারে চরে মধুপুর। ইসলামিক ইউনিভার্সিটি পৌছার এক কিলোমিটার আগের স্টেপেজটাই মধুপুর। মধুপুর নেমে স্কুটারওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এখানে খাবার হোটেল কোথায়?

স্কুটারওয়ালা হাত দিয়ে রাস্তা সংলগ্ন পূর্ব পাশের একটি ভাঙা হোটেল দেখিয়ে বলল, ঐ হোটেলে যান, ভালো খেতে পারবেন।

হোটেলের চেহারা দেখে স্কুটারওয়ালার উপর খুব রাগ হলো, মুখে কিছু না বলে মনে মনে স্কুটারওয়ালার চৌদ্দ গোষ্ঠি উদ্ধার করে গালি দিলাম, ব্যাটা আমাদের এত নিচু ভাবলো কি করে? ভাঙা হোটেল দেখিয়ে বলে ঐ হোটেলে যান। মনের ভিতরের রাগ প্রকাশ না করে পুনরায় বললাম, আরে ভাই এটা নয়, যেখানে ভালো গরুর মাংস রান্না হয় সেই হোটেল কোনটা?
স্কুটারওয়ালা আবার আঙুল দিয়ে এই হোটেলটিই দেখিয়ে বলল, ঐ তো ঐটাই।
স্কুটারওয়ালা বললেও বিশ্বাস হলো না। যেখানে দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসে গরুর মাংস খাওয়ার জন্য, ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা আসে, বড় বড় হোমরা চোমড়ারা আসে, সেই হোটেল এইরকম ভাঙাচুড়া হয় কি করে?

স্কুটারওয়ালার কথা বিশ্বাস না হওয়ায় আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আরেকজন রিক্সাওয়ালাকে বললাম, ভাই, এখানে ভালো গরুর মাংস খাওয়ার হোটেল কোনটা।
তিনিও দেখিয়ে দিলেন ঐ হোটেলটাই। কেমন ধন্দের মধ্যে পড়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম নতুন পেয়ে আমাকে সবাই কি আহাম্মক ভাবছে নাকি? আমি বলি ভালো হোটেল এরা সবাই দেখিয়ে দেয় ভাঙা হোটেল। রিক্সাওয়ালা স্কুটারওয়ালার কথায় বিশ্বাস না রাখতে পেরে আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে রাস্তাদিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন বয়স্ক পথচারিকে জিজ্ঞেস করলাম, চাচা, এখানে খাওয়ার ভালো হোটেল কোথায়?

তিনিও ঐ ভাঙা হোটেলটিই দেখিয়ে দিলেন। তিনজনের কথার পরেও বিশ্বাস হচ্ছে না। অবশেষে দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যেই হোটেলে গিয়ে ঢুকলাম। হোটেলে ঢুকে ভিন্ন পরিবেশ পেলাম। বাইরে ভাঙাচুড়া হলেও ভিতরের পরিবেশ একেবারে খারাপ নয়। বাইরে থেকে বাঁশের খুঁটির উপরে পলিথিন দেয়া দেখলেও ভিতরে চারদিকে হাফ ওয়াল করা এবং হাত ধোয়ার জন্য পাকা করা বেসিনে পানির ট্যাপ লাগানো আছে। ট্যাপ ঘুরাতেই গলগল করে ঠান্ডা পানি পড়ে। টেবিলগুলো কাঠের হলেও টেবিলের উপরে নকশী করা রাবার ক্লথ দিয়ে বেশ পরিপাটি করেই সাজানো। প্রত্যেক টেবিলেই চেয়ার দেয়া আছে। চেয়ার টেবিল অনুযায়ী প্রায় পঁচিশ ত্রিশজন লোক একবারেই বসে খেতে পারে।

আমি ভিতরে ঢুকে দেখি তখনও দশবারোজন ভাত খাচ্ছে। তাদের সবার পাতেই গরুর মাংস। কারো মুখে কোন কথা নাই সবাই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য হোটেলে যেমন এই পানি দে, ছালাদ দে, ডাল দে বলে চিল্লাচিল্লি করে এখানে সেধরনের কোন চিল্লাচিল্লি নেই। সবাই খুব আয়েশ করেই খাচ্ছে।

আমিও হাত মুখ ধুয়ে একটি টেবিলে বসলাম। সাথে আমার গিন্নি এবং ছোট ছেলে। কিছু বলার আগেই ভাত আর এক বাটি করে গরুর মাংস দিয়ে গেল। পরিমাণে কম নয় ঢাকার হোটেলের তুলনায় অনেক।

মাংসের চেহারা খারাপ নয় তারপরেও শুধু ভাঙাচূড়া ঘরের কারণে অল্প একটু ঝোল ভাতের সাথে মাখিয়ে নিয়ে মুখে দিতেই চোখ কপালে উঠে গেল, অসম্ভব স্বাদ হয়েছে, আমি যা কল্পনা করি নাই তার চেয়েও বেশি। সামান্য ঝোল খেয়েই আমার দ্বিধাদ্বন্দ কেটে গেল। পুরো বাটির মাংস একবারেই ঢেলে নিলাম। তাকিয়ে দেখি আমার ছেলের মুখেও রা নেই, গো গ্রাসে খাচ্ছে। কিন্তু এত স্বাদ হওয়ার পরও স্বাদের প্রশংসা করতে পারছিলাম না। কারণ সাথে গিন্নি আছে। গিন্নিরা নিজের বিস্বাদের রান্নার প্রশংসা শুনতে ভালোবাসলেও অন্যের ভালো রান্নার প্রশংসা শুনতে রাজি নয়। সব গিন্নিদেরই প্রায় একই অবস্থা, গিন্নি ক্ষেপে যাবার ভয়ে যেমন হোটেলের রান্নার প্রশংসা করতে পারছিলাম না তেমনি কোন স্বামীরই উচিৎ নয় গিন্নিকে খ্যাপানো। হাজার হলেও গিন্নিরা বাড়ির গভর্ণর। তাদের ক্ষ্যাপালে কপালে দুর্গতি আছে। তার পরেও গিন্নির দিকে তাকালাম। আমি কিছু বলার আগেই গিন্নি বলল, মাংস খুব স্বাদ হয়েছে।

এমনিতেই আমি খেয়ে খুব তৃপ্তিবোধ করছি তারোপর গিন্নি যখন বলল খুব স্বাদ হয়েছে তখন গিন্নিকে নিয়ে যে ভয় ছিল তা কেটে গেল, মনের মধ্যে দ্বিগুন সাহস পেলাম। একশতে একশ’ ভাগ নিশ্চিত হলাম আসলেই মাংস স্বাদ হয়েছে। গিন্নির কথা শুনে খুশির চোটে মেসিয়ারকে আরো এক বাটি করে অতিরিক্ত মংস দিতে বললাম। মাংস খেয়ে পেট ভরে গেলেও মন আর ভরে না, মন ভরার জন্য আরো একবাটি মাংস নিলাম।

পাঠক হয়তো ভাবছেন আমি বোধ হয় অতিরিক্ত গাল গল্প করছি, না ভাই– মাংস খেয়ে মনে হলো বিগত দশ বছরের মধ্যে এমন রান্না আর কখনও খাইনি। আসলেই মাংস অসম্ভব স্বাদ হয়েছিল।

খাওয়ার সময় হুশ ছিল না তাই দাম দেয়ার সময় মনে মনে চিন্তায় পড়ে গেলাম– বাটি ভরে এতগুলো মাংস দিয়েছে দাম নিশ্চয় অনেক নিবে। কিন্তু মেসিয়ারকে জিজ্ঞেস করে যখন জানতে পারলাম প্রতি বাটি মাংসের দাম মাত্র আশি টাকা তখন আফসোস করতে লাগলাম, আহারে– এই দামটা যদি খাওয়ার আগে জানতাম তাহলে গলা পর্যন্ত খেয়েছিলাম তখন চোখ পর্যন্ত খেয়ে উঠতাম। কিন্তু খাওয়া শেষ করে উঠায় আবার বসতে মন চাইলো না। আরো খাওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্বেও দাম পরিশোধ করে গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম।

তবে সত্যিই এত স্বাদের মাংস অনেক দিন হলো খাওয়া হয় না। মাংস খেয়ে লোভ লেগে গেল, সকালে আবার ঐ হোটেলে গেলাম। হোটেল ঘরের সামনের অংশে হাতের বাম পাশে দেয়াল ঘেসে উঁচু চৌকির উপর রান্না করা তরকারী সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হাঁড়ি, কড়াইয়ের উপর একবার করে চোখ বুলিয়ে নিলাম। বড় একটি কড়াইতে গরুর মাংস। মাংস থেকে তখনও ধোঁয়া বের হচ্ছে। বিশাল একটি সিলভারের গামলায় ভাত আরেকটি গামলায় খিচুড়ি। ভাত এবং খিচুড়ি থেকেও গরম গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। ছোট একটি হাঁড়িতে খাসির মাংস, আরেকটি গামলায় সবজি এবং কড়াই ভরা ডাল। এই কয়েকটি পদ ছাড়া মাছ, মুরগী বা অন্য কোন তরকারী চোখে পড়ল না।

গরম গরম খিচুড়ি পেয়ে ভাত না নিয়ে খিচুড়িই নিলাম। খিচুড়ির সাথে গরুর মাংস খেয়ে আরও বেশি তৃপ্তিবোধ করলাম। এত মজার যিনি রান্না করেন তাকে দেখার খুব ইচ্ছা হলো, ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলাম। তিনি আর কেউ নন– এই হোটেলের মালিক নিকবার ভাই। নামটাও চমৎকার। আমি ঢাকা থেকে তার রান্নার প্রশংসা শুনে এসেছি জেনে তিনি খুবই খুশি হলেন। আমাকে বসিয়ে তিনি আন্তরিকতাপূর্ণ আপ্যায়ন করে চা খাওয়ালেন। অনেক সময় তার সাথে কথা হলো। তিনি নিজেই এই মাংস রান্না করেন। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এই হোটেল শুরু করেছেন। তখন থেকে তিনি একইভাবে রান্না করে যাচ্ছেন, যে কারণে স্বাদের কোন হেরফের হয় না। প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ কেজি মাংস লাগে। তার এই হোটেলে যে একবার মাংস খেয়ে যায় সে ঘুরে ঘুরে আবার এসে খেয়ে যায়। যে কারণে হোটেল ঘরের সামনের অংশ ভাঙা হলেও শুধু সুস্বাদের জন্য কাস্টমারের কমতি হয় না।

হোটেল ঘরটি ভালো করেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে নিকবার ভাই যা বললেন তা হলো এই, পুরো ঘরটিই পাকা করেছিলেন। ফখরুদ্দিন সরকারের সময় আর্মিরা বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয়ায় এর পর তিনি আর মেরামত করেন নাই। হোটেলের সামনের অংশ ভাঙা হলেও পিছনের অংশ নিজের জমি হওয়ায় ঠিকই পাকা করেছেন। বাইরে থেকে খারাপ দেখা গেলেও ভিতরের পরিবেশ একেবারে খারাপ নয়।

শুধু স্বাদের দিকে চিন্তা করেই মনে মনে নিয়ত করেছি যদি আবার কখনও কুষ্টিয়া বেড়াতে যাই তখন আর কিছু না খেলেও ঐ হোটেলের মাংস খেতে মোটেও ভুল করবো না।

****

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *