দগ্ধ হৃদয় (দ্বিতীয় র্পব)

ইসহাক আলী প্রামানীক

ধীরে ধীরে অনেক বেলা হয়েছে ॥ রোদের প্রখরতা তেমন নেই ॥ ছেলে মেয়েরা দলে দলে স্কুলের পথে রওনা হয়েছে ॥ এমন সময় ইনামুল স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ী থেকে বেড় হলো ॥ কিছুদুর এগোতেই পিছন থেকে কে যেন ডাক দিলো ॥ তখন ইনামুল ফিরে দেখে হাসিনার আব্বা তার দিকে আসছেন ॥ ইনামুল দাড়িয়ে পড়ল। নিকটে এসে বললো তুমি কি স্কুলে যাচ্ছ ॥
-জ্বী চাচা মিয়া ॥ আপনাকে বেশ কিছুদিন হল দেখা যাচ্ছে না। তা কোথায় গিয়েছিলেন চাচা ॥
-ওই স্কুলের কাজের জন্য ঢাকায় ছিলাম কয়েকদিন, তা একটা কথা বাবা ॥
-কি চাচা মিয়া ॥
-আবুল ছেলেটা খুব দুষ্ট ॥
-ও, বুঝেছি চাচা ॥ আর বলতে হবে না, আপনি বুঝি হাসিনার কাছে শুনেছেন, তবে আবুল পূর্বে অনেক ভাল ছিল ॥ তবে সঙ্গ দোষে আজকাল খারাপ হতে চলেছে ॥ আমি ওর আব্বাকে গতকাল জানিয়েছি।
-কার আব্বাকে ?
-আবুলের আব্বাকে।
-তা ওর আব্বা তোমাকে কি বললো ?
-উনি বললেন, আচ্ছা আবুল বাড়ী ফিরলে, ওর কাছে আগে শুনি তারপর ব্যবস্থা নেবো। তবে বুঝতে পারছি আবুল একটু বেয়ারা হয়ে যাচ্ছে। ওর চলার গতি আর লেখাপড়ার ভাব দেখেই বুঝতে পেরেছি ॥ তাই বাড়ীতে একটা শিক্ষা না দিলে আর হচ্ছে না ॥
-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে ॥ তবে আর যদি কোনদিন দুষ্টামী করে আবুল তাহলে আমাকে একটু জানাবে।
-ঠিক আছে চাচা মিয়া, আমি জানাবো ॥
তারপরে মৌলভী সাহেব চলে গেলেন ॥ ওই সময়ে হাসিনা বাড়ী থেকে বেড়িয়ে আসলো স্কুলে যাওয়ার জন্য। দুজনে এক সাথে স্কুলের পথে রওয়ানা হলো ॥
ওদিকে আবার আবুল স্কুলে আগেই পৌছে গিয়ে কিছু তার স্বভাবমনা ছেলেদেরকে নিয়ে দল গঠন করে নিল ॥
মনসুর ও ইউনুসকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার ধারে আম গাছের নীচে সব কথা পাকা করে নিল। কিন্তু এ ব্যাপারটা ইনামুল কিছুই জানতনা। আবুল সবাইকে বুঝিয়ে ছিল এই ইনামুল হারামজাদা আমাকে আব্বাকে দিয়ে মার খাওয়ায়েছে।
ব্যাপারটা কিরে খুলে বলনা, কেন তোকে মার খাওয়ালো ? মনসুর আবুলকে প্রশ্ন করলো ॥ আবুল বললো ব্যাপারটা কিছুই না ভাই। রাস্তা দিয়ে যেতে আমি একটু দুষ্টোমি করেছি আর কি ? তাতে নাকি ইনামের মাথায় পাক লেগেছে, তাই ব্যাটা আমার উপর ভীষণ গরম ॥
-কেমন ধরণের দুষ্টোমি, কার সঙ্গে ॥
-তার মানে ইনামের বাড়ীর কাছে একটি মেয়ে আছে জানি ওর কিছু হয় না, তবু ওই মেয়ের সঙ্গে স্কুলে যাতায়াত করে ॥
-ইউনুস জিজ্ঞাসা করল, কোন মেয়েটারে ?
-আবুল জবাব দিল ওইযে অষ্টম শ্রেণির জানালার ধারে বসে আছে ॥
-ও ওই মেয়ে ॥ তাইতো দেখতেও বেশ চমৎকার ॥
-হ্যা ওই মেয়েটার পিছনে আমি একদিন লেগেছিলেম, তাই নাকি ইনামের মাথায় বজ্রপাত হয়েছে ॥
-ইনামের কিছুই হয় না অথচ এরূপ বাড়াবাড়ী মানে কি? মনে হয় ওর সঙ্গে ইয়েটিয়ে আছে। মনসুর বললেন।
-শুধু ওর সঙ্গে কেন ? মেয়েটির বাড়ীর প্রত্যেকটি লোকই ওকে ভালোবাসে।
-আর এসব বাদ দে ভাই, এখন আমার কিভাবে হবে তার একটা উপায় করে দাও।
-তাহলে আমরা এজন্য কি করতে পারি, ভাই ?

এমন একটা ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করো যেন ইনামুল আর কোন দিন ওই মেয়ের সাথে আসা-যাওয়া না করে ॥ ওর রক্তের গরম কিছুটা কম করে দিতে হবে।
-তখন ইউনুস ও মনসুর চোখে চোখে যেন কি একটা বুদ্ধি করে নিল এবং পরে ইউনুস বললো ভাই বুদ্ধিতো বেড় করেছি, কিন্তু কার্য্যকরী করাই তো কঠিন কাজ ॥
-তবে কিছু দিতে হবে নইলে তোমার কাজ করা যাবে না। তুইতো জানিস ইনামুলকে সকলেই ভালোবাসে এমনকি স্কুলের স্যারেরাও ॥ তাই ওকে শায়েস্তা করা একটু কঠিন কাজ, সকলেই পারবে না ॥
-তাহলে তোরা কি চাস? আবুল বললো।
-কিছু টাকা। ইউনুস বললো।
-টাকা। তোরা পেশাদার লাঠিয়াল নাকি যে তোরা টাকা চাস ॥ খুব না হয় মিষ্টি খাওয়ার জন্য কিছু নিতে পারিস। তাই বলেতো অনেক টাকা চাইতে পারিস না।
-তা ঠিকই বলেছিস ॥ কিন্তু ইনামকে মারবো কোন দুঃখে ওতো আমাদের কোন ক্ষতি করে নাই। দ্বিতীয়তো ওকে মেরে যে ঝামেলা হবে তা সামলাবে কে তুমি না আমরা ॥ তাই ঝামেলা যাতে না হয় তার জন্যই টাকার দরকার।
-তা টাকা দিয়ে কি করবি ?
-ওকে মেরেই আমরা শহরে চলে যাবো। আমরা তো তোর কারণে আজ স্কুলে অনুপস্থিত ॥ তাই ওকে মেরে আমরা শহরে যাবো সিনেমা দেখবো। খাওয়া দাওয়া করবো আবার যাওয়া আসার খরচ এটা কে দেবে? তাই মোটা টাকার দরকার ?
-তা শহরে যাওয়ার এবং সিনেমা দেখার দরকার কি ?
-আরে বুদ্ধরাম তোর মতো কাঁচা মাথা আমাদের নেই? কাল যখন ইনামুল মার খেয়ে আমাদের নামে স্যারের নিকট নালিশ করবে, তখন কি হবে ?
-কি হবে তখন ?
-আমরা বলবো স্যার কাল আমরা স্কুলে ছিলাম না শহরে গিয়ে ছিলাম ॥
-স্যার জিজ্ঞেস করবে, কেন গিয়েছিলে।
-তখন আমরা ভয়ে ভয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলবো স্যার ভালো একটা ইংলিশ ছবি এসেছিলো কিনা তাই…
-এই তোরা যে ছবি দেখতে গিয়েছিলে তার প্রমাণ কি ?
-তখন আমরা টিকেটের মুড়িটা দেখাবো বুঝলিতো ॥ হয়তো স্যার আমাদের বিচার করবে না ॥
-কিন্তু ভাই অতো টাকা যে নেই আমার কাছে।
-না ভাই তাহলে আমরা আর পারবো না।
-ঠিক আছে আমার কাছে এখন যা আছে তা নিয়ে যাস। পরে খরচ যা হয় দিয়ে দিবো।
-ঠিক আছে তাই দে-বাকী পরে দিস ?
-এখন কেন ? আগে কাজ করে দে-পরে যদি না করিস ॥
-ওও আমরা যদি কাজ সেরে ফেলি আর তুমি যদি নিজকে সাধু সাজার জন্য ভেগে পরো তাহলে কি হবে।
-আমি অতো ছোট লোক নই যে পালিয়ে যাবো। অতো বড় নিমক হারামি করবো না ॥
-ঠিক আছে তাই হবে, মনসুর বলল, এখন বুদ্ধিটা শোন আবুল ॥ ছুটির পরে আমি ইনামুলকে ডেকে আড়ালে নিয়ে যাবো। তোরা স্কুলের পিছনে থাকবি ॥ আশা করি ইনামুল আমার সাথে কথা বলতে আসবে ॥ আমরা ঊভয়ে যখন আলাপ করতে থাকবো তখন তোরা ধীরে ধীরে সামনে এসে পড়বি আর আবোল-তাবোল বকতে থাকবি ॥ কথাকাটির মাঝে দমাদম কয়েকটা কিলঘুষি মেরে দিয়ে মাটিতে ফেলে দিতে থাকবি। আমি তখন তোদেরকে আটকানোর চেষ্টা করবো বলবো এই তোরা কি করছিস, এই ভালো লোকটাকে তোরা মারছিস কেনো। আমি আটকাতে যাবো, আমাকেও ধাক্কা দিবি আর ওকে মেরে দিবি। আমার কথার সুপারিশে কোন কর্ণপাত করবি না বুঝলি তো।
-যদি তোর কথায় ও না আসে ! আবুল বললো ॥ বরং বাড়ীর পথে রওয়ানা দেব ॥
-তাহলে আমরা তিন জনেই ওর পিছনে যাবো। তারপর তখন ঝাউবনের কাছে যাবে, তখন সবাই গ্রিম করে ধরে ফেলবো, রাস্তা থেকে সরে একটু বনের ভিতরে নিয়ে হাত পা বেঁধে আচ্ছা করে মেরে ফেলে দিয়ে চলে যাবো ॥ আর ঝাউবনের ভিতর নিয়ে যাওয়ার কারণ কি জানিস !
-না। কারণ কি ?
-ঝাউবনের ভিতর নিয়ে মারামারি করলে কেউ দেখবে না।
-ঠিক আছে তাই চলো ॥ সকলেই বাজারের দিকে চলে গেলো ॥
স্কুল ছুটি হলো, তখন হাসিনা ও ইনামুল উভয়ে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো। এমন সময়ে মুনসুর বেড়িয়ে আসলো এবং ইনামুলকে পিছন থেকে ডাকতে শুরু করলো। ইনামুল পিছন ফিরে দেখে মুনসুর। মুনসুরকে কেউ ভালোবাসেনা, কারণ, তার ব্যবহার আচরণ উৎভট এবং বান্ডুলে ও ভবঘুরের মতো। স্কুলে সে কতই না খারাপ করেছে যার হিসাব দেয়া মুস্কিল। তার জন্য তাকে অনেক শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু তবু ওর স্বভাব একটুও বদলায় নি। তাই ইনামুলও ওকে ঘৃণার চোখে দেখে। তাই ইনামুল মুনসুরের আচার ব্যবহারের প্রতি লক্ষ্য করে জবাব দিল, আমার হাতে সময় নেই, দাড়াতে পারবো না।
মনসুর বললো বেশী নয় দু-মিনিট তোর সঙ্গে একটা বিশেষ কথা আছে।
তখন ইনামুল চিন্তা করতে লাগলো আমার সঙ্গেতো কোন দিন মুনসুরের তেমন সখ্যতা নেই এবং কথাবার্তাও নেই। তাহলে আজকে কোন দরকার থাকতে পারে না আমার সাথে। নিশ্চয় ওর কোন কু-মতলব আছে। তাই ইনামুল আবার বললো না এখন কিছুতেই অপেক্ষা করা যাবে না। তোমার সাথে বিকালে কথা হবে। কারণ বাড়ীতে আমার বিশেষ কাজ আছে। এই বলে ইনামুল দ্রুত রাস্তা চলতে লাগলো। তখন মুনসুর কোন উপায় না পেয়ে পূর্বের যুক্তি পরামর্শ অনুযায়ী, ওরা ঝাউবনের দিকে যেতে লাগলো। কিছুদুর যাওয়ার পর ইনামুল পিছন ফিরে দেখে মুনসুর ও তার বন্ধুরা দ্রুত পিছনে পিছনে আসছে। তার সাথে আবুল, ইউনুসকে দেখা যাচ্ছে। তখন ইনামুলের ব্যাপারটা বুঝতে বাকী রইল না। তাই ইনামুলও হাসিনাকে নিয়ে দ্রুত ঝাউবন পার হতে লাগলো। এমন সময় আবুলের বাবার সাথে ইনামুলের দেখা হয়ে গেল। ইনামুল রাস্তায় এসে আবুলের বাবার জন্য রাস্তায় দাড়ালো। আবুলের বাবা ইনামুলকে দেখে, কি বাবা এখানে দাড়িয়ে কেন?
চাচা আপনার সাথে কথা বলার জন্য দাড়ালাম।
-তা কি কথা বাবা, আর আবুল কোথায় ?
-চাচা আপনি কি আবুলকে কিছু বলেছিলেন।
-কেন কি হয়েছে ?
-আবুল প্রতিশোধ নেয়ার জন্য দল বেধে আমাকে ধাওয়া করছে। আবুলের বাবা দেখতে পেল রাস্তার দিকে দুজন ছেলেকে নিয়ে খুব জোড়ে আসছে।
আবুলের বাবা ইনামুলকে নিয়ে রাস্তার এক পাশে চুপ করে দাড়িয়ে রইল। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওরা সবাই কাছাকাছি এসে পড়লো। আবুল ভালো করে চেয়ে দেখে ইনামুলের কাছে তার বাবা দাড়ানো। ওমনি সকলকে ইশারা দিয়ে ছুটে চলে যেতে বললো।
বললো বাবা ইনামুলের কাছে দাড়িয়ে আছে। এ অবস্থা আমাদের সবাইকে দেখলে, বাবা আমাদেরকে জ্যান্ত রাখবে না। এই বলে সবাই পালাতে চেষ্টা করলো। আবুলের বাবা ওদের পালাতে দেখে পিছনে পিছনে ধাওয়া করলো। আবুলের বাবাকে দৌড়াতে দেখে ইউনুস ও মুনসুর তাড়াতাড়ি ঝাউবনের ভিতরে পালিয়ে গেল ॥
এরপর ইনামুল একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলো। আবুলের সাথে আর কোন দিনই ইনামুলের এরপর দেখা হয় নাই। পরে ইনামুল খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে যে আবুলের পড়া চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেছে। ইনামুল মনে মনে ভাবলো যে রকম ছেলে সেই রকম শাস্তি হয়েছে। কথায় বলে না যে রকম ব্যাধি সেই রকম দাওয়াই। এখন কেমন হলো বাছাধন দিন-রাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোদ্রে কাজ করছিস ॥ সুখে থাকতে ভুতে কিলায় ॥ মনে ভালো লাগেনা, এখন মজা বোঝো বাছাধন ॥

(চলবে)

ছবি ঃ গুগল

তৃতীয় পর্ব পড়ার জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করুন

দগ্ধ হৃদয় (তৃতীয় র্পব)

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *