কুয়াকাটা ভ্রমণ এবং জঙ্গলের ভিতর

কুয়াকাটা সমুদ্রের পাড়ে বিশাল একটি নারিকেল বাগান। সমুদ্রের ঢেউয়ে কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে তারপরেও বাগানটি আকারে বিশাল। যে ভদ্রলোক এই বাগানটি তৈরী করেছিলেন জানিনা তিনি বিনিময়ে কি পেয়েছেন? তবে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের কাছে এর সৌন্দর্য অতুলনীয়।

নারিকেল বাগানের পূর্ব পার্শ্বে বিশাল জঙ্গল। সৈকতটি যেমন পূর্ব দিকে খালে গিয়ে শেষ হয়েছে তেমনি জঙ্গলটিও এই খালে গিয়ে শেষ হয়েছে।

আমি সকাল বেলা নাস্তা করে বেলা দশটার সময় সমুদ্র সৈকত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে গেলাম। সেখানে গিয়ে এক রাখাইন মহিলাকে জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ কেটে বের হতে দেখে আমার মনে হলো হয়তো জঙ্গলের উত্তর পার্শ্বে লোকজনের বসতি আছে। সেই কথা চিন্তা করতে করতে আরেকটু পূর্ব পাশে গিয়ে ঠিকই বনের ভিতরে ঢোকার একটি রাস্তা দেখতে পেলাম। রাস্তাটি খুব বড় নয়, মানুষের যাতায়াতেই রাস্তাটি তৈরী হয়েছে। মনে হলো লোকজন হয়তো সমুদ্র সৈকত থেকে অহরহ এই পথে লোকালয়ে যাতায়াত করে। সেই অনুমান করে বেলা এগারোটার সময় বনের সেই রাস্তা দিয়ে উত্তরের লোকালয়ে যাওয়ার জন্য ঢুকে গেলাম। বনের গভীরে ঢোকার পর বিপদে পরে গেলাম। গভীর বনে রাস্তার কোন চিহ্নই নাই। একা একা কোন দিকে যাবো বুঝতে পারতেছি না। যে রাস্তায় গিয়েছি সে রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছি না। উল্টা পথে সমুদ্র সৈকতে ফিরে যাবো তাও পারছি না। রাস্তা হারিয়ে বেদিশা হয়ে গেলাম। রাস্তার কথা জিজ্ঞাস করার মত আশে পাশে কোনো লোকও খুঁজে পাচ্ছি না। গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস না থাকায় ভয়ে পড়ে গেলাম। কোন জীব জন্তু যদি এই অবস্থায় আক্রমণ করে বা বন দস্যুরা এসে মেরে ফেলে, এই জঙ্গলে চিল্লালেও কেউ শুনবে না। ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। নিজের আহাম্মকির জন্য নিজেই কান্না করার অবস্থা। বিধাতাকে স্মরণ করে অনুমানের উপর শুধু উত্তর দিকে হাঁটতে লাগলাম। অনেকক্ষণ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটার পর উত্তর পশ্চিম দিকে গাছ কাঁটার ঠক ঠক আওয়াজ পেলাম। উপায়ন্তর না দেখে ঐ আওয়াজ ধরেই এগোতে লাগলাম। একসময় গাছের উপরে চড়া অবস্থায় কালো মোটাসোটা দাড়িওয়ালা একটি লোককে দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে দেখা মাত্রই কিছুটা ধমক দিয়ে বললেন, আপনি কে?
বললাম, আমি বেড়াতে এসেছি।
— বেড়াতে এসেছেন তো এখানে কেন?
— একটু জঙ্গল ঘুরে দেখতেছি।
— আপনি একা না সাথে কেউ আছে?
— না আমি একা।
— আপনার সাহস তো কম নয়, একা একা জঙ্গলে ঢুকে ঘুরে বেড়ানো শুরু করেছেন?
— সাথে কেউ নাই তো এই জন্য একা ঘুরতেছি।
— আপনি এখন কোন দিকে যাবেন?
— বেড়ি বাঁধে যাবো।
— বেড়ি বাঁধে যাওয়ার রাস্তা পান না?
— না, পাচ্ছি না।
লোকটি গাছে চড়ে থেকেই বলল, একটু পশ্চিমে যান বেড়ি বাঁধ যাওয়ার রাস্তা পাবেন। সাথে সাথে এও সতর্ক করে দিলেন, আর কখনও জঙ্গলের ভিতর একা একা ঢুকবেন না। বিপদ-আপদ হতে এক মুহুর্তও সময় লাগবে না।
লোকটি আমাকে বিপদ-আপদ হতে পারে এমন সতর্ক করে দিলেন বটে কিন্তু কি বিপদ হতে পারে তা কিছু বললেন না। আমিও জঙ্গলের মধ্যে ভয়ে ভয়ে ছিলাম তাই উল্টো তাকে আর জিজ্ঞেস করলেম না। তবে তার কথামত পশ্চিম দিকে যেতে লাগলাম।

আমি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কিছুটা পশ্চিমে যেতেই পায়ে চলার রাস্তা পেয়ে গেলাম। ওই রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ উত্তরে যেতেই বেড়ি বাঁধ পেয়ে গেলাম। আহম্মকের মত জঙ্গলের ভিতর ঢুকে বিপদেই পড়েছিলাম। বেড়ি বাঁধে উঠে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখি জামা-কাপড়সহ পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। পানি পিপাসায় আর নড়তে পারছি না। এতক্ষণ হুঁশ ছিল না, তাই শরীরের এ অবস্থা বুঝতে পারিনি। পূর্ব পাশে একটি বাড়ি ছিল। হাঁটতে হাঁটতে সেই বাড়িতে গিয়ে পানি খেতে চাইলে, আট দশ বছরের একটি ছেলে এক গ্লাস পানি এনে দিল। পানি খেয়ে বেড়ি বাঁধের উপরে উঠে গাছের ছায়ায় অনেকক্ষণ বসে জিরিয়ে নিলাম। এর পর উঠে আস্তে আস্তে কুয়াকাটা বাজারের দিকে রওনা হলাম। মনে মনে কান ধরে তওবা করে বললাম, এমন আহম্মকী আর জীবনেও করবো না।

বেড়ি বাঁধ ধরে বাজারের কাছাকাছি আসার আগেই একটি বৌদ্ধ মন্দির চোখে পড়ল। কুয়াকাটা বাজার থেকে অল্প পূর্বদিকে বেড়ি বাঁধ সংলগ্ন উত্তর পাশে। মন্দিরে কোনো লোকজন নেই। মন্দিরের দরজায় তালা দেওয়া। ভিতরে বিশাল আকৃতির বৌদ্ধ মূর্তি। মন্দিরের চার পাশ ঘুরে দেখে আবার বেড়ি বাঁধে উঠে এলাম। ক্লান্ত শরীরে আর ঘুরতে ইচ্ছা করছিল না, তাই সোজা হোটেলে গিয়ে ঢুকলাম।

হোটেলে গিয়ে গোসল করে মোল্লা হুজুরের দোকানে খেতে গেলাম। আজকেও ইলিশ মাছ ভাজা, চিংড়ি মাছ ভুনা এবং ডাল দিয়ে খেলাম। খুব ভাল লাগল। ভাত খেয়ে হোটেলের রুমে এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে বিকালে আবার সৈকতে গেলাম। এবার পূর্ব দিকে না গিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে লাগলাম। সৈকতের পশ্চিম দিকে জেলে পল্লী এবং শেষ প্রান্তে কালি নদী। আমি প্রায় এক দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে যাওয়ার পরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখি একটি জেলে নৌকা সমুদ্র থেকে মাছ নিয়ে ফিরতেছে। আমি জেলেদের মাছ দেখার জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। নৌকা সৈকতের কিনারে এসে থামলে মাছের ঝাকা নামিয়ে নিয়ে এলো। ঝাকায় ছোট বড় প্রায় এক মণের মত ইলিশ মাছ। অন্য কোন মাছ নেই। নৌকা সমুদ্রের পানি থেকে ঠেলা গাড়িতে তুলে সৈকতের উপরে জোয়ারের পানি যেখানে না পৌছে এমন উঁচু জায়গায় নামিয়ে রাখল। আমি কাছে গিয়ে তাদের নামানো মাছগুলো দেখতে ছিলাম। এমন সময় বেড়ি বাঁধ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক চলে এলো। লোকটি এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়?
আমি বললাম, ঢাকা থেকে এসেছি।
আমি ঢাকা থেকে এসেছি জেনে লোকটি হেসে হেসে বলল, আপনি সমুদ্র দেখতে এসেছেন?
বললাম, হ্যাঁ।
আমার সাথে অনেক কথা হলো। জেলেরা মাছ নিয়ে চলে গেলেও লোকটি আমার সাথে কথা বলতে ছিল। কুয়াকাটার পশ্চিম পাশের সৈকত থেকে বেড়িবাঁধ খুব কাছে। মাঝখানে কোন জঙ্গল নেই। লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বাড়ি কোনটা?
তিনি হাত উঁচু করে বেড়ি বাঁধের ওইপারে বাড়ি দেখালেন। আগে তাদের বাড়ি বেড়ি বাঁধের এই পাশে ছিল। সমুদ্র এখান থেকে প্রায় এক মাইল দক্ষিণে ছিল। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস ইত্যাদির আঘাতে তট ভেঙে ভেঙে বর্তমানে এখানে এসেছে। তাদের পূর্বের বাড়ি আঙুল উঁচিয়ে সমুদ্রের ভিতরে দেখালো।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সত্তরের ঘুর্ণি ঝড়ের সময় কত বড় ছিলেন?
তিনি আমার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বললেন, তখন আমি এগারো বারো বছর বয়সের ছিলাম।
এগারো বারো বছর বয়সের কথা শুনে আমার ভিতরে সত্তরের সেই ভয়ঙ্কর ঘুর্ণিঝড় সম্পর্কে জানার আগ্রহ জন্মাল। বললাম, আপনার কি সত্তরের ঘুর্ণিঝড়ের কথা মনে আছে?
লোকটি মাথা ডান দিকে কাত করে ছোট্ট একটি ঝাকি দিয়ে বললেন, হ্যাঁ মনে আছে, পুরো ঘটনাটাই আমার মনে আছে। ঘুর্ণিঝড় যখন শুরু হয় তখন হঠাৎ করে বৃস্টি বাতাসের সাথে সমুদ্রের পানিও বৃদ্ধি পেতে থাকে। পানি বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে বাড়ি ঘর তলিয়ে যাওয়ার অবস্থা। ঝড়ো বাতাসের সাথে সাথে বড় বড় ঢেউ এসে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা দেখে বাড়ির সবাই জীবন বাঁচানোর জন্য গাছের উপরে উঠে যায়। আমার বাবা-মা অন্য গাছে উঠেছে। আমার ছোট চাচা আমাকে এবং আমার বড় ভাইকে নারকেল গাছে উঠিয়ে দিয়ে চাচীকে আনার জন্য বাড়ির ভিতরে যায়। এক বুক পানির ভিতর চাচা চাচীকে হাত ধরে আনতে ছিল। এমন সময় ঝটকা বাতাসের সাথে বড় একটি ঢেউ এসে চাচা-চাচীকে হাত ধরাধরি করা অবস্থায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখেও আমরা কোন সহযোগীতা করতে পারিনি। সেই ভেসে যাওয়ার পর থেকে চাচা-চাচীর আর কোনো খোঁজ পাইনি। ঘুর্ণিঝড়ের পরে আমার বাবা, চাচাসহ আত্মীয় স্বজন যারা বেঁচে ছিলেন তারা অনেক খুঁজেছেন, কিন্তু তাদের কোথাও পাওয়া গেল নাই, এমন কি তাদের লাশটাও পাওয়া গেল না।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ওই চাচার কোন বাচ্চা-কাচ্চা নাই?
লোকটি বলল, না –হ , আমার চাচা মাত্র ছয়মাস আগে বিয়ে করেছিলেন। এই জন্য তার কোন বাচ্চা-কাচ্চা নাই।
কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, আপনাদের এখানে ইলিশ মাছ কত করে কেজি বিক্রি হয়?
আমার এ কথা শুনে তিনি একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সে কথা আর কি বলবো বাবা, আমরা তো পানির দামে মাছ বেঁচি। এক কেজি বা তার চেয়েও বড় সাইজের ইলিশ ৮০ টাকা কেজি, আট শ’, নয় শ’ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০ টাকা কেজি, আধা কেজি ওজনের ইলিশ ৬০ টাকা কেজি, আধা কেজির নিচের ইলিশ সব জাটকা হিসেবে ৪০ টাকা কেজি।
আমি বললাম, এত বড় ইলিশ মাত্র আশি টাকা কেজি বিক্রি করেন, এই ইলিশ তো ঢাকায় আড়াই শ’ তিন শ’ টাকায় বিক্রি হয়। এগুলো নিয়ে আপনারা অন্য কোন জায়গায় যেতে পারেন না? অন্য জায়গায় গেলে তো অনেক বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন।
লোকটি আমার এ কথায় আরেকটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, বাবা, আমরা তো মহাজনের কাছে হাত পা বাঁধা। আমরা যারা মাছ মারি তাদের প্রত্যেকের দাদন নেয়া আছে। দাদনওয়ালা ছাড়া অন্য কোথাও মাছ দিতে পারবো না।
— আপনিও কি দাদন নিয়েছেন?
— জি, আমারও বাইশ হাজার টাকা দাদন নেয়া আছে। এই বাইশ হাজার টাকা শোধ দিতে দিতে ইলিশ ধরার মওসুম শেষ হয়ে যাবে, তখন আবার হয়তো দাদন নেয়া লাগবে।
— আপনার কে মাছ মারে?
লোকটি হাসি দিয়ে বলল, একটু আগে এখান থেকে যে দুইজনে মাছ ঘাড়ে করে নিয়ে গেল, ওই দুইটাই আমার ছেলে। বাকি যে তিনজন ছিল ওরা আমার বড় ভাইয়ের ছেলে। আমরা তিন ভাই ছিলাম। দুই ভাই বেঁচে আছি, আর ছোট ভাই কয়েক বছর আগে মারা গেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কয় ছেলে?
তিনি তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, আমার তিন ছেলে। এখানে দুইজনকে দেখলেন, আরেক জন বাজারে দোকান করে।
বললাম, আপনার কোনো জমাজমি নাই?
আমার এ প্রশ্নে অসহায়ের মত বলল, একসময় বাপদাদার অনেক জমিজমা ছিল। এখন সব সমুদ্রের মাঝে। এখন ওসব জমির কথা না বলাই ভাল। বর্তমানে পঁচিশ শতকের উপর বাড়ি ভিটা ছাড়া আর কোন আবাদি জমি নাই। ছেলেদের মাছ মারার উপরেই সংসার চলে।
লোকটির সাথে আরো অনেক কথা হলো। এখানকার মাছ শিকারীরা যে দাদনের জাতাকলে আছে সেটা লোকটির কথা বলার সময় তার দীর্ঘ নিঃশ্বাস দেখেই টের পেলাম। পশ্চিমে সূর্য ঢলে পড়েছে। আমাকে আবার দেড় কিলোমিটার ফিরে যেতে হবে। কাজেই দেরি করা উচিৎ হবে না। লোকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

পরদিন ঘুম থেকে উঠেই সমুদ্র সৈকত দিয়ে পূর্ব দিকে গেলাম। যাওয়ার সময় দেখি এক লোক কোমর পানিতে নেমে দুইটি বাঁশের খুটি দুইদিকে পুঁতে তার মাঝখানে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ হাত লম্বা ফাঁসি জাল পেতে দাঁড়িয়ে আছে। তার জাল পাতা দেখে পূর্ব দিকে চলে গেলাম। প্রায় এক ঘন্টা পর ফিরে এলাম। এসে দেখি লোকটি পানি থেকে উঠে এসে সৈকতে বসে আছে। বললাম, বড় ভাই, তখন যে জাল পাতলেন, মাছ পেয়েছেন?
আমার কথা শুনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, না এখনও জাল তুলি নাই, আমাদের মাছের নৌকা আসবে, তখন তুলবো।
— মাছ নিয়ে কখন আসবে?
— সময় হয়ে গেছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবে।
তার কাছে দাঁড়িয়ে দশ পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতেই দূরে সমুদ্রের পানিতে ছোট্ট একটি নৌকা দেখা গেল। দেখতে দেখতেই নৌকাটি বড় হতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইঞ্জিন চালিত মাঝারি আকারের নৌকা সৈকতের কিনারে চলে এলো। নৌকা কিনারে আসার পর সৈকতে বসে থাকা লোকটি ঠেলা গাড়ি নিয়ে নৌকার কাছে চলে গেলে সবাই মিলে নৌকা ঠেলা গাড়িতে তুলে সৈকতের উপরে এনে বালুর উপরে নমিয়ে রাখল। নৌকা সৈকতে রেখে লোকটি পানিতে নেমে জাল তুলে আনল। জালে মাঝারি ধরনের তিনটি ইলিশ মাছ পড়েছে। মাত্র এক দেড় ঘন্টার মধ্যে তিনটি ইলিশ মাছ জালে আটকাতে দেখে আমার কাছে খুব আনন্দই লাগল। আমি মাছগুলি হাতিয়ে দেখলাম। টাটকা ইলিশ। রান্নার ব্যবস্থা থাকলে মাছগুলি কিনে নিতাম। কিন্তু সে সুযোগ না থাকার পরেও জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি মাছগুলি বিক্রি করবেন?
লোকটি হাসি মুখে জবাব দিলেন, না, এ তিনটি আমাদের খেতে লাগবে।
আরো কিছুক্ষণ সৈকতে ঘোরাঘুরি করে বেড়ি বাঁধের উত্তরে চলে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে মাছের আড়তে চলে গেলাম। সমুদ্র থেকে জেলেরা ঝাকা ভর্তি মাছ নিয়ে আসতেছে আর আড়তদার দাড়ি পাল্লা দিয়ে মেপে মেপে খাতায় পরিমান লিখছে। অনেকেই মাছ মেপে দিয়ে খালি হাতে চলে যাচ্ছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, মাছ দিলেন টাকা নিলেন না।
তিনি জবাব দিলেন, ভাই আমাদের দাদন নেয়া আছে, দাদন শোধ না দেয়া পর্যন্ত তারা আমাদের টাকা দিবে না।
আরেকজন মাছ নিয়ে রাস্তায় মুখ কালো করে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, মাছ নিয়ে বসে আছেন কেন, আড়তে দিবেন না?
লোকটি ক্ষোভের সাথে বলল, ভাই কি কমু দুকখের কথা, মুই বাড়ি থাইকা মাছ মাইপ্পা আনছি পয়ত্রিশ কেজি, হেরা মাপে একত্রিশ কেজি, হেই দুকখে মুই মাছ লই রাস্তায় বই রইছি। শালারা দামেও কম দেবে, আবার ওজনেও বেশি নেবে।
বললাম, ওরা ওজনে বেশি নিলে অন্য জায়গায় যান।
আমার এমন কথায় লোকটি অসহায়ের মত বলল, যামু কেমবে? হেইয়ার কাছে তো ধরা। দাদন নেয়া আছে। দাদন শোধ না দেলে তো যাইততে দেবে না।
সমুদ্র পাড়ের জেলেদের মহাজনের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এখনও যেন ক্রীতদাসের প্রথা বহাল আছে।
মোল্লা হুজুরের দোকানে এসে পেট ভরে ভাত খেয়ে হোটেলে চলে এলাম। সকাল দশটার দিকে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ব্যাগসহ নিচ তলায় এসে ম্যানাজারের কাছে চাবি বুঝিয়ে দিলাম। হোটেল থেকে বের হয়ে মোল্লা হুজুরের দোকানে চলে এলাম। হুজুরের কাছে বিদায় চাইতেই বসতে বললেন, এক কাপ চা তিনি নিজ হাতেই বানিয়ে দিলেন। চায়ের দাম দিতে গেলেও নিলেন না বরঞ্চ আরো আন্তরিকতার সাথে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। তার এই আথিথায়েতার কথা জীবনেও ভুলতে পারবো না। মোল্লা হুজুরের ব্যবসার সততা এবং আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে আমি সত্যিই মুগ্ধ। হুজুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা বাস স্টেশনে এসে ঝালকাঠিগামী বাসে উঠলাম। তবে ঝালকাঠি না গিয়ে আমতলি নেমে পড়লাম।

(চলবে)

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *