নারায়ণ সরকার

যাকে শ্রদ্ধা করা যায় সে জাতপাত ভুলে কত সহজে আপন হয়ে যায় তা বলার ভাষা থাকে না। তেতাল্লিশ বছর পর এই দাদার সাথে দেখা। প্রথম দেখায় আমাকে চিনতে পারেন নাই পরিচয় দেয়ার পড়ে ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে আবেগে আপ্লুত হয়ে গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। তার অবস্থা দেখে আমার চোখের কোনেও জল চলে এলো।
নাম নারায়ণ সরকার। আমার ন্যাংটা কালের বন্ধু নরেন্দ্রনাথ সরকারের বড় ভগ্নিপতি। নরেনের বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র তিনশ’ গাজ দূরে। আমাদের বাড়ি আর নরেনদের বাড়ির মাঝে আর কোন বাড়ি ছিল না। শিশুকাল থেকে স্কুল জীবন, কলেজ জীবন দু’জনের একসাথেই কেটেছে। ভারতে যাওয়ার পরও সে বারবার বাংলাদেশে বেড়াতে আসতো এবং আমাদের বাড়িতে দুই দিন হলেও থাকতো।
নরেনের বড় বোনের যখন বিয়ে হয় তখন 1967 বা 68 সাল হবে। আমি এবং নরেন তখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। যতটুকু মনে পড়ে ঔ বিয়েতে আমিসহ অনেকেই সারারাত বিয়ে বাড়িতে ছিলাম। তখন হিন্দু বাড়ির বিয়ে দেখার অন্যরকম একটা মজা ছিল। সারা রাত নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হতো।
তখনকার হিন্দু বিয়ে মানেই ঢোলের সাথে কাসার ঘন্টা আর সানাই বাজতো। ঢোলের মাতাল করা বাজনার তালে তালে ঢুলির নাচ আর মন মাতানো সানাইয়ের সুর শুনতে শুনতেই রাত পার হয়েছিল। ঐ বিয়েতে হিন্দু মুসলিম পুরো বাড়ি ভরা লোক ছিল। মনে পড়ে বিয়ের লগ্ন ছিল শেষ রাতে। শেষ রাতে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে ঢুলিদের কলার পাতায় খেতে দিয়েছিল। ঢুলিদের খাওয়ার পরিমাণের কথা মনে হলে এখন আমার চোখ কপালে উঠে যায়। কলার পাতায় পাহাড় পরিমাণ ভাত সাথে আলু-বেগুন ভাজা, পাঁচ মিশালি সবজির নাবড়া, এবং অনেক বড় সাইজের রুই মাছের ঝোল। এগুলো দিয়েই একেক জন ঢুলি কমপক্ষে এক কেজি চাউলের ভাত খাওয়র পরও মনে হচ্ছিল তাদের পেট পুরোপুরি ভরে নাই আরো দিলে আরো খাবে। অথচ ঐ পরিমাণ ভাত বর্তমানে ছয় সাতজনেও খেয়ে শেষ করতে পারবে না। তখন মানুষের মুখে যেমন রুচি ছিল তেমনি সার কেমিক্যাল ছারা ভাতের স্বাদও ছিল। তখনকার সময় হিন্দু বিয়ের অনুষ্ঠানে বড় বড় মাছ খাওয়ানো হতো কোন ধরনের মাংস খাওয়ানো হতো না। হিন্দুদের বিয়ে বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে মাংস খাওয়ার প্রচলনও ছিল না।
কিছুদিন আগে ভারত থেকে নরেনের বড় ভাইয়ের ছেলে আমাকে মেসেঞ্জারে জানালো নারায়ণ দাদার অসুস্থ্যতার কথা। তখন থেকেই মনে মনে ভেবেছিলাম দেখতে যাবো। কিন্তু দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তার শুধু নাম জানি কোন ঠিকানা জানি না। ঠিকানার অভাবে আর যাওয়া হয় না। ভারতের সাথে যোগাযোগ করে শুধু গ্রামের নাম রামচন্দ্রপুর ছাড়া আর কোন লোকেশন পেলাম না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম রামচন্দ্রপুর গ্রামের দূরত্বও কম নয়, আমার বাসা থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার।
গতকাল কাউকে কিছু না জানিয়েই বেড়িয়ে পড়েছিলাম। প্রথমেই গাইবান্ধা থেকে ট্রেনে চড়ে গেলাম বোনারপাড়া জংশন, সেখানে নেমে অনেক জিজ্ঞাসার পর গেলাম রিক্সা ভ্যানে বটের তল, বোনারপাড়া থেকে বটের তল তিন কিলোমিটারের কম নয়, গ্রামের ভিতর তিন রাস্তার মোড়ের বটেরতলের দোকানদারদের জিজ্ঞেস করে কোন সদুত্তর না পেয়ে দ্বিধা দ্বন্দে পড়ে গেলাম, শহর থেকে চড়া রৌদ্রের ভিতর গ্রাম্য রাস্তায় এতদূর এসে কি আবার ফিরে যেতে হবে। এত কষ্ট করে এসে এমন যাত্রা বিফল হোক এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। ফোন দিলাম ভারতের জলপাইগুড়িতে। যার কাছে ফোন দিলাম সে শুধু গ্রামের নাম রামচন্দ্রপুর ছাড়া আর কিছুই জানে না। না জানার কারণও আছে, যার কাছে ফোন দিয়েছি তার জন্মটাই ভারতে। সে বাংলাদেশের পথঘাট চেনা তো দূরের কথা জীবনে বাংলাদেশেই আসে নাই।
অবশেষে অনুমান করেই চলে গেলাম দুই কিলোমিটার দূরের শিব শঙ্কর বাজারে, সেখানে খুঁজে খুঁজে একজন হিন্দু বয়স্ক দাদাকে পেলাম, উনাকে জিজ্ঞেস করে আরও বিপদে পড়ে গেলাম। বয়স্ক দাদা উল্টো আমাকেই জিজ্ঞেস করল, এখানে তিনজন নারায়ণ আছে, আপনি কার কাছে যাবেন? আমি বললাম তাদের বাড়ি কোন কোন জায়গায়? উনি বলল একজনের বাড়ি ভুতমারা ঘাটের পশ্চিমে আরেক জনের বাড়ি মাদানী বাড়ির দক্ষিণে আরেকজনের বাড়ি কোথায় যেন বলল। নারায়ণ দাদার একটি ছেলের নাম মনে ছিল তার নাম বলতেই বলল, ও চিনেছি, বলেই একটি রিক্সা ভ্যান ডাক দিয়ে বলল, মাদানী বাড়ির দক্ষিণে নারায়ণের বাড়ি যাবে সুন্দর করে নিয়ে পৌঁছে দিয়ে আয়। হিন্দু দাদার কথায় ভ্যানওয়ালা আর না করলো না। ভ্যানে চড়ে রওয়ানা হলাম, পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় প্রায় দুই কিলোমিটার যাওয়ার পড়ে বাড়ি খুঁজে পেলাম।
প্রথমে আমাকে কেউ চিনতে পারল না কারণ তরাও আমাকে কখনও দেখে নাই আমিও তাদের দেখি নাই। যখন বললাম আমি নারায়ণ দাদার শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছি। এ কথা বলার সাথে সাথে যেন পুরো বাড়িতে হইচই পড়ে গেল। উত্তর দক্ষিণ বিশাল বাড়ি। নারায়ণ দাদার সাত ছেলে এবাড়িতেই থাকে। আমার বন্ধু নরেনের বড় বোন বাপের বাড়ি থেকে লোক এসেছে এই খবর পেয়ে কোথা থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। বয়স্ক মানুষ আবেগে আপ্লুত হয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করতে লাগলেন। জাতপাত ভুলে ভাই বোনের এমন সম্পর্কের মমতাময়ী দৃশ্য খুব কমই চোখে পড়ে।
একটু পরে নারায়ণ দাদাও লাঠি ভর দিয়ে কোথা থেকে যেন কাঁপতে কাঁপতে এসে হাজির। চোখে কম দেখে কানেও কম শোনে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথা বলতে হয়। এসে আমার পরিচয় পেয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। আমার বন্ধু নরেন্দ্রনাথ সরকার 1985 সালে এ বাড়িতে বেড়াতে এসে তিন দিনের জ্বরে মারা গিয়েছে। নরেন মারা যাওয়ার আগে ভারত থেকে বেড়াতে এসে তিনদিন আমার বাড়িতে আমার কাছেই ছিল। এরপর বড় বোনের বাড়ি এসে মারা যায়। নরেন মারা যাওয়ার পর শ্বশুরের গ্রাম থেকে এই আটত্রিশ বছরে আর কেউ আসে নাই। আমিই প্রথম এসেছি। নরেন মারা যাওয়ায় আমিই যেন নরেনের অভাব পুরণ করতে এসেছি। নারায়ণ দাদা আমাকে নিয়ে খুব ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। আমাকে কোথায় বসতে দিবেন কি খাওয়াবেন নিজেই ছেলের বউদের নানা ফরমায়েশ দিতে লাগলেন। আহারে ভালোবাসা! আমি যেন তাদের আদর ভালোবাসায় নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়েই ফেললাম। আমি বাড়ি ফিরতে চাইলে আমাকে কোনভাবেই যেতে দিতে রাজি হচ্ছিল না অনেক অনুরোধ করেই বিদায় নিতে হয়েছে। বাড়ি ফেরার সময় নারায়ণ দাদার বড় ছেলে আমাকে অনেক দূর পযর্ন্ত মটরসাইকেল চড়িয়ে এগিয়ে দিয়ে গেছে। এই আন্তরিকতার তুলনা হয় না।

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *