মেঘনায় নৌকা ভ্রমণ ও কামাল উদ্দিনের লটকন (৬০০তম পোষ্ট)

এটি আমার ৬০০তম পোষ্ট। ইচ্ছা ছিল ছয়শ’তম পোষ্টটি আমার প্রয়াত বন্ধু অমিত রায়হানকে নিয়ে লিখব। যার স্মৃতি আমি কখনই ভুলতে পারবো না, ধর্মান্তরিত হওয়ার পর যে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে নামায পড়া শিখিয়েছিলাম, তাকেই আবার সেই হাত দিয়েই কবর দিতে হয়েছে। পরবর্তী পোষ্টটি তার নামেই পোষ্ট করার আশা আছে।

নীল সাধু ভাইয়ের একরঙ্গা এক ঘুরি সংগঠনের আয়োজনে এবার ট্রেন, বাস, নৌকা ভ্রমণে গিয়েছিলাম। নীল সাধু ভাই প্রত্যেক বছরই এই আয়োজন করেন, তার এই অবদানের তুলনা হয় না। অনেক দিন থেকেই তিনি এই আয়োজন করে আসছেন। তার কারণেই আমরা ব্লগ জগতের অনেকের সাথে সরাসরি পরিচিত হওয়াসহ ভার্চুয়াল থেকে রিয়েল ফ্রেন্ডে পরিণত হতে পেরেছি। এই অবদানের জন্য তাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই।

প্রত্যেক বছরই এমন আয়োজন করলেও আমার পক্ষে যাওয়ার সৌভাগ্য হয় না, কারণ সময়-সুযোগ-কর্মস্থল সব মিলিয়ে এক করতে না পারার ব্যর্থতায় ভুগতেছিলাম। এবার মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে করেই হোক যাবোই যাবো এবং বিধাতা আমার যাওয়ার সেই ইচ্ছেটা পূরণও করেছে।

ছবি ব্লগার সাদা মনের মানুষ ওরফে কামাল উদ্দিন ভাইয়ের আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হলাম। নরসিংদী স্টেশনে ট্রেন থামতেই ফোন দিলাম কামাল ভাইকে। কামাল ভাই জিজ্ঞেস করলেন আপনি কোথায়? বললাম, আমরা এখন নরসিংদী স্টেশনে আছি নৌভ্রমণে যাচ্ছি। সাথে ব্লগার কামরুন নাহার আপা, রুহি, আলভি, নীল সাধুসহ সর্বমোট একাত্তর জন আছি। ভৈরব থেকে নৌকা নিয়ে মেঘনা নদীতে ঘুরবো বিকালে আশুগঞ্জে এসে বাসে ঢাকায় ফিরবো। উনি শুধু বললেন সময় পেলে বিকালে এসে দেখা করে যাবো।

তার এই ছোট্ট কথাটা এমনভাবে পালন করবেন আমরা বুঝতে পারি নাই। বিকালে নৌকা আশুগঞ্জে আসার আগেই উনি ফোন দিয়ে বললেন আমি নৌকা ঘাটে এসে বসে আছি। আমরা নৌকা থেকে নেমেই দেখি কামাল ভাই তার বন্ধুসহ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে যেতেই অতি আদরে কোলাকুলি করলেন। কোলাকুলি শেষ হতে না হতেই কিছু বুঝে উঠার আগেই গাড়ির বনেট খুলে দিলেন। বনেট ভর্তি লটকন আর কলা। তাও আবার যেকোন জায়গার লটকন কলা নয়, বটেশ্বর থেকে নিয়ে এসেছেন। তার এহেন কর্ম দেখে থ হয়ে গেলাম। একটা ভার্চূয়াল জগতের মানুষ কতটা আন্তরিক হলে ঝুড়ি ভর্তি লটকন আর কলা নিয়ে প্রায় একশত কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে আসতে পারে সেটা চিন্তা করাও কল্পনার বাইরে। নিজের আত্মীয়ও হয়তো এমন পরিশ্রম করবে না। তার এই অবাক করা কান্ড দেখে সবাই মুগ্ধ। সাদা মনের মানুষ নিক নেম হলেও তিনি প্রকৃত পক্ষেই সাদা মনের পরিচয় দিলেন। এমন আন্তরিকতা সাধারণত নজিরবিহীন।

গাড়ির বনেট খুলে দেয়ায় লটকন খাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যায়। হুড়োহুড়ির পরও প্রত্যেককেই এক খামছা করে লটকন পেয়েছেন। উপরের লটকনগুলিও কামাল ভাইয়ের আনা লটকনের কিয়াদাংশ। এই লটকনের বিশেষত হলো যেমন বড় তেমন মিষ্টি। এরকম মিষ্টি লটকন সাধারণত বাজারে পাওয়া যায় ন।

ছবি-০১

কমলাপুর থেকে ছাড়ার পর ট্রেনের ভিতরের ছবি।

ছবি-০২

পাশাপাশি বসা বাবা ও ছেলে। নিরাহংকার একটি মানুষ। বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত থাকার পরও তাঁর অহংকার নাই। ছোট বড় সবার সাথে মেশার প্রবনতা দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তাঁর নরম ব্যবহারে অন্তর থেকেই শ্রদ্ধা বেরিয়ে আসে। এরকম লোক জীবনে খুব কমই দেখেছি। ইনিই আমাদের ছবির রানী খ্যাত কামরুন্নাহার আপার স্বামী।

ছবি-০৩

এনারা দুইজন বউ শ্বাশুরি হলেও মা মেয়েও বলতে পারেন। একজন শ্বাশুরী কত ভালো হলে ছেলের বউকে মেয়ের মত আদর করতে পারেন তার উদাহারণ আমার এই বোনটি। সারা রাস্তাই ছেলের বউয়ের প্রত্যেকটি আবদার মায়ের মতই পুরণ করে গেছেন। কখনও চিপস কিনে, কখনও চানাচুর কিনে, কখনও বিস্কুট কিনে, আবার লালপুর বাজারে গিয়ে চায়ের সাথে সিঙ্গারাও কিনে খাইয়েছেন অর্থাৎ যখন যা খেতে চেয়েছে তাই কিনে দিয়েছেন, আমার এই বোনটি কখনও না করেন নাই। আবার শ্বাশুরির মত শ্বশুরও মাটির মানুষ। পুরো পরিবারটিই একটি সুখি পরিবার। পুরো রাস্তায় তাদের প্রত্যেকটি ঘটনা কাছে থেকে দেখতে পেরে খোদার কাছে এই কামনা করেছি যদি পৃথিবীর প্রত্যেকটি শ্বশুর শ্বাশুরি এমন হতো তাহলে কোন ছেলের বউ কখনই কষ্ট পেত না।

ছবি-০৪

ভৈরব রেল স্টেশন।

ছবি-০৫

ভৈরব রেল স্টেশনে সবাই এক লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ছবি তুলেছেন ব্লগার ফেরদৌসা রুহি।

ছবি-০৬

ভৈরব নদীর ঘাটে পৌছার পর সবাই ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরে।

ছবি-০৭

চারজন পুরানো ব্লগার নদীর পারে একত্র হয়েছেন। পরিচয় নাইবা দিলাম।

ছবি-০৮

আরেকটি সুখি দম্পত্তি। যে কোন ঘুরির আয়োজনে এই দুইজনকে সব সময় একত্রে পেয়েছি। তাদের মানসিকতা খুবই উন্নত। তাদের মধ্যে কখনও ঝগড়া হয় কিনা জানিনা। তবে যে কোন কাজে তাদের সমভাবে সহযোগীতা করতে দেখে অভিভুত হয়েছি।

ছবি-০৯

ভৈরব ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ার পূর্ব মুহুর্তের ছবি।

ছবি-১০

মেঘনার বুকে নৌকা এবং নৌকার ছাদে ভ্রমণকারীগণ। সামনে বসা সরোয়ার খুবই রসিক মানুষ পুরো পরিবার নিয়ে এসেছেন। দলের সবাইকে মাতিয়ে রাখার জন্য তিনি একাই যথেষ্ঠ।

ছবি-১১

মেঘনা নদীতে চলন্ত নৌকার ছাদে আরামের সাথে অনেকেই কাত চিত হয়ে ভয়াবহ মেঘনার দৃশ্য অবলোকন করছেন।

ছবি-১২

নৌকায় যাওয়ার পথে লালপুর বাজারে চা বিরতি দেয়া হয়। নদীর পারেই একটি চায়ের দোকান। খাঁটি গরুর দুধের চা। খেতে খুবই মজাদার। কেউ কেউ একসাথে দুই তিন কাপ পর্যন্ত খেয়েছে।

ছবি-১৩

লালপুর বাজারে বিক্রির জন্য আনা তাজা বেলে মাছ। পানিতে রেখেছে খলবল করে নড়ছে। দেখেই জিহ্বায় জল আসে কিন্তু শুধু দূরুত্বের কারণে এই তাজা মাছ পেয়েও কেনা হলো না।

ছবি-১৪

আমরা এখন গন্তব্যে এসে গেছি। আমাদের গন্তব্য স্থান পারের শান বাঁধানো ঘাট এবং পিছনের দালান বাড়ি।

ছবি-১৫

নৌকা থেকে নামার দৃশ্য।

ছবি-১৬

এটি নীল সাধু ভাইয়ের নানার বাড়ি। উনার নানা একজন আউলিয়া ছিলেন। আজমীর শরীফে গিয়ে তিনি লেখাপড়া করেন এব্ং সেখানকার মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। পরে বাবার নির্দেশে দেশে ফিরে এসে এলাকায় ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। আউলিয়া হিসাবে তাঁর যথেষ্ঠ সুনাম আছে।

ছবি-১৭

বাড়িটি দেখতে খুবই দৃষ্টি নন্দন এবং পরিবেশও বেশ চমৎকার। সামনে অনেকটা খোলামেলা জায়গা।

ছবি-১৮

বাড়ির সামনের আমগাছের ছায়ায় ঝিরিঝিরি সুশীতল বাতাসে মনোরম আড্ডা।

ছবি-১৯

নৌকা ঘাটে পৌছার পর অনেকেই বানের জলে নেমে মনের আনন্দে গোসল করছে।

ছবি-২০

সামনে দিগন্তজোড়া মাঠের পশ্চিম পাশে শান বাঁধানো ঘাটে বসার ব্যবস্থা দেখে মনে হলো– যদি চাঁদনি রাতে সবাই মিলে আড্ডা দিতে পারতাম তাহলে কত মজাই না হতো! চমৎকার পরিবেশ!! এরকম খোলামেলা পরিবেশ সাধারনত খুব কমই পাওয়া যায়। খুবই ভালো লাগল ঘাটের এই পরিবেশটি।

ছবি-২১

ছবিটি দেখে হয়তো অনেকেই মনে করবেন ব্লগাররা ধ্যানে বসেছেন। আসলে ধ্যানে নয় উনারা খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন।

ছবি-২২

অনেক দিন পর মাটির সানকিতে খাওয়ার সৌভাগ্য হলো। মাটির সানকি পেয়ে ছোটকালের সেই আউশ ধানের পান্তাভাতের কথা মনে পড়ে গেল। কত মজা করেই না পুরো এক সানকি পান্তা ভাত খেয়ে ফেলতাম।

ছবি-২৩

মজাদার শুটকি ভুনা।

ছবি-২৪

অনেক দিন পরে গ্রামীণ পরিবেশে ভাতের সাথে শুটকি ভুনা, মাংস, বিলম্ব দিয়ে রান্না করা ডাল এবং সাথে ঘরে পাতা খাঁটি দুধের দই খেয়ে টান টান হয়ে গেলাম।

ছবি-২৫

এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের থানা কান্দা গ্রামের দৃষ্টিনন্দন বাড়ি থেকে আড্ডা শেষে বিদায়ের পালা। গ্রামটি মেঘনার পূর্ব পারে অবস্থিত।

ছবি-২৬

গ্রামের এমন দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়েছে।

ছবি-২৭

প্রায় আড়াই ঘন্টা একটানা চলার পর আশুগঞ্জ ঘাটে নৌকা থেকে নামার দৃশ্য।

ছবি-২৮

আশুগঞ্জ থেকে ঢাকা ফেরার পথে রিজার্ভ করা সোহাগ পরিবহন বাসের ভিতরের দৃশ্য।

সব শেষে এটুকুই বলবো এমন আয়োজনে আর কিছু না হোক ভার্চুয়াল থেকে রিয়েল ফ্রেন্ড হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। নুতন পুরান অনেকেই এই আয়োজনে এসেছিলেন, অনেকের সাথে এবারও পরিচয় হয়েছে তারমধ্যে দুইজনের সাথে আমার সরাসরি যোগাযোগ হলো যাদেরকে আমি দীর্ঘ দিন থেকে চিনি অথচ স্বচক্ষে দেখি নাই, তারা হলেন কবি সেলিম আনোয়ার এবং জাহাঙ্গীর আলম পিডিবি।

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *