দগ্ধ হৃদয় (পঞ্চম র্পব)

ইসহাক আলী প্রামানীক

ভোর বেলা। দক্ষিণা শীতল বায়ু বইছে। জনতা হয়ত শায়িত অবস্থা হতে গাত্রোত্থান করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এর পূর্বেই পাখীর কলরবের সারা পেয়ে ইনামুল বাইরে হাটতে বেড়িয়েছে। রাস্তা ধরে সে নদীর তীর পর্যন্ত ঘুরে এল। ইনামুল পূর্বেও প্রাতঃ ভ্রমণ করেছে অনেক বারই॥ কিন্তু আজকের মত ভোরে আর কোন দিন সে বেড়াতে যায় নাই। সে গত রাতে বাড়ী এসেছে হাসিনার সাথে দেখা করতে॥ হাসিনার সাথে দেখা করার জন্য তার মনটা যেন ছটফট করতেছে॥ মনে হয় সে কলেজ থেকেই সোজা বাড়ী এসেছে, হাসিনার নামটি মনে হয় তজবীর মত জপতে জপতেই এসেছে। তাই মনে হয় তার ভাল ঘুম হয় নাই। রাস্তায় ও নদীর ধারে কিছুক্ষণ ঘুরা ঘুরি করে সে বাড়ী ফিরে এলো কিন্তু হাসিনার সাথে তার দেখা হল না।
হাসিনা আগে ভোরে বাড়ীর বাইরে ঘুরে বেড়াত? কিন্তু এখন তার চাচা করিম সাহেবের কড়া শাসনে পাড়ায় আর ঘুরে বেড়ান হয় না। আগে সকালে ঘুরত এ কথা মনে করেই ইনামুল ঘুরতে এসেছিল। কিন্তু হাসিনাকে দেখতে না পেয়ে নিজের বাড়ীর দিকে ফিরে গেল।
বাড়ী ফিরে ইনামুল ঘরে বসে বসে কি যেন ভাবতে শুরু করল। এমন সময় ইনামুলের মা ঘরে প্রবেশ করে বলল কিরে বাবা এই ভোর বেলাতে যে ঘরে ঝিম লেগে বসে আছিস। তোর কি শরীর খারাপ করেছে ?
ইনাম তাড়াতাড়ি নিজকে সামলে নিয়ে বলল, না মা এমনি বসে আছি॥
– তা ঘরে বসে আছিস কেন ?
– তা এখন এই ভোরে আর কি করব মা ?
-কেন অনেক দিন পরে বাড়ীতে এলি, তা যানা হাসিনাদের বাড়ীর ওদিকটা ঘুরে আয় না।
-তা যাব বৈকি মা। তবে এখন না বিকালের দিকে॥
-আরে হ্যা তোদের হোষ্টেলে কি খাবার খুব কষ্ট হয়। বাড়ীর মতকি করে খাবার দেয়।
-আম্মা কিযে বলেন, ওইখানে খাবার কষ্ট হবে কেন? মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে খাবার দরকার তা দেয়, সে ভাবেই দেয়। তাছাড়া খাবারে কোন ভেজাল থাকে না। হোষ্টেলের খাবার খারাপ দিলে ওদের চাকুরী যাবে যে। তবে বাড়ীর মত যা ইচ্ছা তাই খাওয়া যায় না। ওই খানে খাবারের একটা পরিমাণ আছে। সেই পরিমাণ মত খেতে হয় এবং সময় মত॥ যখন তখন ইচ্ছা করলেই খাওয়া পাওয়া যায় না। তবে ওই খাবারে কোন অসুবিধা হয় না। মা ?
-ঠিক আছে কষ্ঠ না হয় তাই ভালো।
-আচ্ছা আম্মা হাসিনাদের খবর কি?
-ওদের অবস্থা ভালই আছে তবে করিম মিয়া ওর লেখা পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাকে এখন বাড়ীতেই আরবী শিক্ষা দিচ্ছে।
-উনি ওর পড়া বন্ধ করলেন কেন? তাকি আপনি ভালো করে শুনেছেন ?
-না। তা কিসের জন্য পড়া বন্ধ করে দিয়েছেন তা বলতে পারব না। তছাড়া ওদের কাউকে বাড়ীর বাইরেও আসতে দেয় না।

তারপর ইনামের মা ঘর থেকে বেড় হয়ে গেল, এমন সময় বাইরে কার যেন কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ইনামুল। দরজা খুলে দেখে কাশেম। স্কুল থেকে বিদায় হওয়ার পর আর কারো সাথেই দেখা হয়নি। তাই আজ কাশেমকে বাড়ীতে দেখে তারো স্কুলের পুড়ানো স্মৃতিগুলো মনে পড়তে লাগল। কাশেমকে ডেকে ঘরে বসতে বলল।
-তা কিরে কাশেম ভালো আছিসত?
-হ্যা খোদার কৃপায় একরকম ভালো আছি বৈকি?
-তা কাশেম তোকে তো দেখাও যায় না?
-ঘরে বসেই কি সবাইকে দেখা যায়। না বাইরে একটু ঘুরে দেখা করতে হবে।
-তা আর যাই কখন। গত রাতে বাড়ী এসেছি। এখনও শারীরিক ক্লান্তি দুর হয় নাই। আচ্ছা তুই এখন কি করতেছিস।
-তা কি আর করব ভাই বাড়ীতেই বসে আছি।
-তা কলেজে ভর্তি হলি না কেন?
-ইচ্ছা তো ছিল, কিন্তু পারিনি।
-কেন ভাই। তোদের তো টাকা পয়সার কোন অভাব নেই,
-কাশেম একটা চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল॥ টাকা পয়সা থাকলেই তো আর পড়া যায় না। আল্লাহর রহমত থাকতে হয়।
-কারণ কি? কি হয়েছে তোর? ইনাম কাশেমের দিকে চেয়ে রইল।
-ও তুই জানিস না তাহলে॥ আমার সুখ দুঃখ সব আল্লাহর কাছে। তিনি যদি আমার প্রতি সহায় হতেন তবে হয়ত আমার ভাগ্য ফিরত। আমার অবস্থা খুবই খারাপ।
-হা তাইতো তোর স্বাস্থ্যতো অনেক খারাপ হয়ে গেছে।
-তা খুলে বলনা কি হয়েছে?
-তুই তো জানিস আমার বাবা অসুস্থ্য ছিল?
-হ্যা তাই তো, তা এখন কি অবস্থা?
-সেতো আর নেই॥ সে এ পৃথিবীর সমস্যা আর সংসার থেকে বিদায় হলেন বটে কিন্তু আমাকে তিনি সংসার খাচায় আবদ্ধ করে গেলেন। যার ফলে আমার আর লেখাপড়া করা সম্ভব হলো না। এখন সংসার নামের গাড়ীর চাকা ঘুরাতে হচ্ছে।
-যা হবার তা হয়েছে। সবাইকে একদিন মরতে হবে। ওসব নিয়ে আর চিন্তা করিস না। অতিরিক্ত চিন্তা করলে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যাবে। তাই নিজ সামাজিক নিয়ে সংসার ভালো করে দেখ। ইনামুল বলল,
-চেষ্টা করছি কিন্তু মন মানছেনা,
-তা কি করবি চাষাবাদ করবি না ব্যবসা বাণিজ্য করবি।
-আপাতত চাষাবাদেই মন দিয়েছি, আর পাশাপাশি আর একটি কাজে হাত দিয়েছি।
-সেটা কি কাজ?
-গ্রামকে কিভাবে উন্নয়নের মধ্যে আদর্শ করা যায়।
-কেমন ভাবে উন্নয়ন করবে?
-ধর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটা স্কুল নাই। তাই প্রাথমিক ভাবে শিশু শিক্ষার জন্য প্রাথমিক স্কুল স্থাপনের ব্যবস্থা করেছি এবং পাঠদান শুরু হয়েছে।
-কি ভাই তুই এই কয়েক মাসের মধ্যে এতদুর অগ্রসর হয়েছিস তা আমি জানতে পারলাম না।
-তবে কথা হলো ছাত্র সংগ্রহ করতে পারিনি। তাই আজ তোর আছে এসেছি ছাত্র সংগ্রহের জন্য আলোচনা করতে।-আরে কি আশ্চর্য্য শুধু ছাত্র সংগ্রহ করার কথা বলছিস কেন? স্কুল উন্নয়নের কথা বলছিস না কেন?
-ঠিক আছে শুধু ছাত্র সংগ্রহ নয় সার্বিক কাজেই আমি তোর সাহায্য সহযোগিতা চাই।
-তুই তো জানিস ভাই কোন জিনিস গড়তে গেলে মাঝে মাঝেই ভাঙ্গন ধরবে। তাই শক্ত হাতে ধরে থাকতে হবে যেন কোন ভাঙ্গন না ধরে।
-তা শিক্ষকের ব্যবস্থা হয়েছে তো?
-বর্তমানে প্রধান শিক্ষকের কাজটি আমি করছি। আর পাড়ার একজনকে নিয়ে দুজনেই চালাচ্ছি। ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেবো।
-আরে বল ছাত্র সংগ্রহের জন্য। আমিও যদি তোর সাথে থেকে ছাত্র সংগ্রহ করতে পারি তবে নিজকে ধন্য মনে করব। আর শোন আমি কয়েক দিন বাড়ীতে আছি চিন্তা করিস না তোর সাথে আমি স্কুলের কাজ করব।
-তবে ভাই, অনেক বেলা হলো এখন পড়াতে যেতে হবে।
-ধন্যবাদ তোকে, ধন্যবাদ তোর প্রতিভাকে। তুই এতো তাড়াতাড়ি যে জনসেবামূলক কাজে নেমে পড়বি আমি ভাবতেই পারিনি। তবে যদি ছাত্র সংখ্যা আশানুরুপ হয় তবে শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করে স্কুল পরিদর্শন করিয়ে নিবন্ধনের ব্যবস্থা আমি করে দেবো। যাতে ভবিষ্যতে স্কুলটি সরকারি হয়।
-হ্যা আমার মনে হয় তা তাড়াতাড়ি করতে পারবো কারণ ২/৩ মাইলের ভিতর কোন স্কুল নাই। তবে চল ভাই গ্রামে ঘুরে আসি। আর দুজনেই আজ স্কুলে পড়াবো।
তারপর তারা দুজনে এক সাথে ছাত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বেড় হলো।

চলবে —

(ছবি গুগোল)

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *