কুয়াকাটা ভ্রমণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

অনেক দিন হলো দূরে কোথাও ভ্রমণ করা হয় না। হঠাৎ কুয়াকাটা দেখার সাধ জাগলো। অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি পেয়েছি। ভ্রমণ করার একটা মক্ষোম সুযোগ মনে হলো। একা একা বাসায় মনও টিকছিল না। কুয়াকাটার কথা মনে হতেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। বিকালের দিকে ট্রাভেল ব্যাগে কাপড়-চোপড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র গুছিয়ে নিয়ে একাই বের হলাম।

সন্ধ্যা সাতটার সময় সদর ঘাট পৌঁছে লঞ্চের কেবিন খুঁজতে গিয়ে নাকাল হলাম। পটুয়াখালীর কোন লঞ্চেই সিঙ্গেল কেবিন খালি নাই। সব ভাড়া হয়ে গেছে। অবশেষে ’নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’ এই কথা মনে করেই ডবল সীটের কেবিনের একটি সীট ভাড়া করে উঠে পড়লাম। কেবিনে গিয়ে দেখি আগে থেকেই এক ভদ্রলোক কেবিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে বেডের উপর বসে আছেন। বয়স খুব বেশি নয়। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে। কেরানী আমাকে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতে একটি চাবি ধরিয়ে দিলেন। কেবিনে বসে থাকা ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কোন কথা বললেন না। ভদ্রলোকের চাহনীতে আমি কিছুটা ইতস্তত করতে লাগলাম। একে তো লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কম, তারোপর অজানা-অচেনা লোকের সাথে একই কেবিনে। এ লোক যদি চোর-বাটপার বা ছিনতাইকারী হয় তাহলে একা পেয়ে আমার বারোটা বাজিয়ে দিবে। যদি এমন হয় আমার টাকা-পয়সা, ব্যাগপত্র রেখে চলন্ত লঞ্চ থেকেই ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিল, তখন আমার লাশটাও আমার পরিবারের কাছে পৌছবে না। আমার এ ভ্রমণের কথা পরিবারের কউকে বলেও আসিনি, বড় চিন্তায় পড়ে গেলাম। মনের ভিতর অজানা আশঙ্কায় দ্বিধা-দ্বন্দ শুরু হয়ে গেল। কুয়াকাটা যাবো না লঞ্চ থেকে নেমে বাসায় ফিরে যাবো? এমন যখন ভাবছি তখন হঠাৎ করেই লঞ্চটি ধাক্কা খেল। হঠাৎ করে লঞ্চ কেন ধাক্কা খেল দেখার জন্য কেবিনের জানালা খুলে বাইরে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি লঞ্চ আস্তে আস্তে পিছনে যাচ্ছে অর্থাৎ ছেড়ে দিয়েছে। লঞ্চ ছেড়ে দেয়ায় অজানা আশঙ্কা সত্বেও আর নামা সম্ভব হলো না। বাধ্য হয়ে কেবিনেই থেকে গেলাম।

ব্যাগটি বিছানার কোনায় বালিশের পাশে রেখে ভদ্রলোকের মত দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম। ভদ্রলোকের দিকে দু’ তিনবার তাকালাম। ভদ্রলোক জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমিও চাঁদনি রাতে বুড়িগঙ্গা নদীর দৃশ্য দেখতে লাগলাম। প্রায় আধ ঘন্টা পরে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। চোখাচোখি হলো। ভদ্রলোক মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমিও কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ পর আবার তাকালাম। দেখি ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলবো মনে করে ভাবছি, এমন সময় তিনি বলে উঠলেনÑÑ
— আপনি কোথায় যাবেন?
— পটুয়াখলী।
— আপনার বাড়ি কি পটুয়াখালী?
— না।
— ওখানে কি চাকরী করেন?
— না।
— আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাবেন?
— না।
— তাহলে কি আপনি ব্যাবসা করেন?
— না।
আমার না না উত্তর শুনে ভদ্রলোক কিছুটা অবাক হওয়ার মত অবন্থা হলো। আমি যাতে আর না না উত্তর না বলি সেই জন্য একটু ঘুরিযে প্রশ্ন করলেন।
— আপনি কোথায় থাকেন?
এ কথার উত্তর হ্যাঁ বা না দিয়ে দেয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়েই কথা বলতে হলো। বললাম– ঢাকা।
— আপনি কি করেন?
— চাকরী করি।
— কোথায় চাকরী করেন?
— সংবাদ পত্রে?
— আপনি কি তাহলে পত্রিকার কাজে যাচ্ছেন?
— না।
এবারো আমার না জবাব পেয়ে ভদ্রলোক চোখ দু’টা বড় বড় করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন–
আপনি তাহলে কি কাজে যাচ্ছেন?
— বেড়াতে।
বেড়াতে যাচ্ছি শুনে ভদ্রলোক চোখ কপালে তুলে আশ্চার্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন — শুধু বেড়াতে?
— জ্বি।
— কোথায় বেড়াবেন?
— কুয়াকাটায়।
কুয়াকাটার কথা শুনে ভদ্রলোকের চোখ সড়াৎ করে কপাল থেকে নেমে স্বাভাবিক জায়গায় স্থাপিত হলো। কিছুটা মৃদু হেসে বললেন– আপনি তাহলে কুয়াকাটা বেড়াতে যাবেন?
— জ্বি।
আমার ‘জ্বি’ বলার পরে আর কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে আছেন। ভদ্রলোকের এত প্রশ্নের পরও আমি তাকে একটি প্রশ্নও করিনি। একই কেবিনে দুইজন মানুষ। একই দিকে যাচ্ছি, তার সম্বন্ধেও কিছু জানা দরকার। তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম– আপনার বাড়ি কি পটুয়াখালী?
— না।
— তাহলে কি ঢাকায়?
— না।
— আপনি কি ব্যাবসা করেন?
— না।
— আপনিও কি বেড়াতে যাচ্ছেন?
— না।
আমার মত তিনিও প্রশ্নের উত্তর না না দেয়ায় কিছুটা বিব্রত বোধ করে প্রশ্নের ধরন পরিবর্তন করে বললাম–
আপনি কোথায় যাবেন?
এ প্রশ্ন করায় তিনিও আর হ্যাঁ বা না দিয়ে উত্তর দিতে পারলেন না। মুখের জবান খুলে উত্তর দিলেন– পটুয়াখালী।
— পটুয়াখালী যাচ্ছেন কেন?
— আমি ওখানে চাকরী করি।
— কিসে আছেন?
— এই কোর্ট কাচারীতে।
— কত দিন হলো আছেন?
— প্রায় দুই বৎসর।
কোর্ট কাচারীতে চাকরী করে শুনে মনে হলো হয়তো নাজির, পেশকার একটা কিছু হবে। যে পদেই চাকরী করুক না কেন, লোকটি যে ধান্দাবাজ নয় এব্যাপারে কিছুটা নিশ্চিত হওয়া গেল। বাকীটা হয়তো সারা রাতে বোঝা যাবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম– আপনার বাড়ি কোথায়?
আমার প্রশ্ন শুনে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন– যশোরে।
— আপনার বাড়ি?
— রংপুরে।
— আপনি দৈনিক না সাপ্তাহিক পত্রিকায় চাকরী করেন?
— দৈনিক পত্রিকায় আছি।
আমার বাড়ি রংপুর এবং দৈনিক পত্রিকায় চাকরী করি শুনে লোকটি মনে হলো কিছুটা স্বাভাবিক হলো। তার ভিতরে ভীতি বা ইতস্ততভাব যতটুকু ছিল তা কিছুটা কেটে গেল। আমিও তার যশোর বাড়ি এবং কোর্ট কাচারীতে চাকরী করে শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। পরবর্তীতে তার সাথে অনেক কথা হলো, কথা বলার এক ফাঁকে তিনি তার আসল পরিচয় দিলেন। তিনি পটুয়াখালী কোর্টের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। নতুন চাকরী পেয়ে সর্ব প্রথম পটুয়াখালী জয়েন করেছেন। জয়েন করার পর থেকে দুই বৎসর হলো এখানেই আছেন। অফিসিয়াল কাজে ঢাকা গিয়েছিলেন। তিনিও আমার মত সিঙ্গেল কেবিন পাননি। আগামী কাল চাকরীতে জয়েন করতে হবে। বাধ্য হয়েই ডবল কেবিনে সীট নিয়েছেন। তার পরিচয় এবং আলাপচারিতায় একটা পর্যায়ে এমন সখ্যতা গড়ে উঠল, কিছুক্ষণ আগে যে তার প্রতি আমার সন্দেহ বা ভীতিভাব ছিল সেটা ভুলেই গেলাম। প্রথমে কেবিনে ঢুকে যাকে চোর বাটপার মনে করেছিলাম, তিনি যে চোর নন চোরের বিচারক, একথা মনে হতেই মনের ভিতর যেমন সাহস এলো তেমনি তার প্রতি শ্রদ্ধাও এলো। দুইজনেই লাইট জ্বালানো অবস্থায় কখনও বালিশে হেলান দিয়ে কখনও বালিশে শুয়ে শুয়ে গল্প করতে লাগলাম। পরিচয় হওয়ার পর থেকে গল্পে গল্পে রাত প্রায় একটা বেজে গেল। ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলাম না। লঞ্চের ইঞ্জিনের ঘর ঘর শব্দ এবং বিছানাসহ দেয়ালের থরথর কাঁপুনিতে নিজেও অনবরত থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। এরকম ঘরঘর শব্দ এবং ঝাকুনি পরিবেশে কখনও ঘুমাইনি, তাই ঘুম তো দূরের কথা মাথাটাও বালিশে রেখে আরামবোধ করছিলাম না। অস্বস্থিবোধ করতে লাগলাম। আমার মত হয়তো তিনিও একই অবস্থা বোধ করছেন। তিনিও ঘুমানোর চেষ্টা করে ঘুমাতে না পেরে একটু পরপরই উঠে আমার সাথে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে লাগলেন।

ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় লঞ্চের ঘর ঘর শব্দ থেমে গেল। আমি দরজা খুলে বাইরে বের হলাম। চেয়ে দেখি লঞ্চ ঘাটে ভিড়েছে। পুনরায় রুমে এসে কাপড়-চোপড় পরে ব্যাগ গুছিয়ে নিতেছিলাম। আমাকে ব্যাগ গুছাতে দেখে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাকে লঞ্চ থেকে নামতে নিষেধ করলেন। বাইরে ফর্সা না হওয়া পর্যন্ত লঞ্চ থেকে নামা যাবে না, কারণ এই সময় ছিনতাই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একবার ছিনতাই কারীরর কবলে পড়লে আর রক্ষা থাকবে না। সব রেখে মারধোর দিয়ে খালি হাতে বিদায় করে দিবে। ছিনতাইকারীর কথা শুনে অন্ধাকারে লঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার উৎসাহে ভাটা পড়ে গেল। বাইরে ফর্সা না হওয়া পর্যন্ত আবার বিছানার উপর বসে কালক্ষেপণ করতে লাগলাম। সাড়ে ছয়টার সময় ভদ্রলোক টয়লেট থেকে এসে কাপড়-চোপড় পরে রেডি হলেন এবং আমাকেও রেডি হতে বললেন। তার সাথে সাথে আমিও কাপড় চোপড় পরে কেবিন থেকে বের হলাম। লঞ্চের লোক বাইরে দাঁড়ানো ছিল, তার কাছে চাবি দিয়ে দুইজনেই লঞ্চ থেকে নেমে এলাম।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তার ভাড়া করা রিক্সায় আমাকে উঠালেন। রিক্সা বাস স্টেশনে এলে আমাকে নামতে বলে তিনিও নামলেন। আমার সাথে সাথে এগিয়ে এসে কুয়াকাটার বাসে তুলে দিয়ে তারপর তিনি রিক্সা ঘুরিয়ে শহরের দিকে চলে গেলেন। পটুয়াখালিতে নতুন এসেছি। আমি যাতে পথ ভুলে অন্য কোথাও না যাই বা ঠক, বাটপার, ছিনতাইকারীর পাল্লায় না পড়ি, সেইজন্য আমাকে বাসে তুলে দিয়ে তবেই তনি বাসার দিকে গেলেন। এই কাজটি করতে গিয়ে তাকে নিজের রাস্তা ফেলে উল্টো পথে অনেক দূর আসতে হয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের এই সহযোগীতা ও সহানুভুতির কথা আজীবন ভুলতে পারবো না।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের দেখানো বাসে উঠে সিট নিয়ে বসে রইলাম। সকাল সাতটার সময় বাস কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। খেপুপাড়া সহ কয়েকটি ফেরীঘাট পার হয়ে বাস যখন কুয়াকাটা পৌছল তখন সময় সকাল সাড়ে এগারোটা।

(চলবে)

Loading

Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *